গনেশ জননী

বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোট গল্পকার বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুল এর অন্যতম ছোটগল্প ‘গণেশ জননী’ কে কেন্দ্র করে আমাদের ধুলোবালির পক্ষ থেকে আপনাদের জন্য রইল এই অডিও স্টোরি ।

একজন মায়ের মাতৃত্ব কতটা সুন্দর এবং দৃষ্টান্তমূলক হতে পারে সেটিকে কেন্দ্র করেই এই মজার গল্পটি

কেমন করে হবো_Ankita Ganguly

কেমন করে হবো

অঙ্কিতা গাঙ্গুলী 

ইচ্ছে হলেই হতাম যদি যা হতে চায় মন

রোজ দুপুরে হতাম আমি পানকৌড়ির বোন।

কিংবা যদি ড্রয়িং খাতার নীল রং টা মাখি,

কেমন সহজে হয়ে যাবো ওই মাছরাঙা রং পাখি।

কিংবা ধরো হতাম যদি মেঘের দেশের রানী

হোম ওয়ার্ক এর অঙ্ক খাতা ভিজিয়ে দিতেও জানি।

ইচ্ছে হলেই হতে পারি কাঁসাই নদীর চর,

হতেও পারি দুয়োরানীর ছোট্ট কুঁড়ে ঘর।

হতাম যদি চাঁদের দেশের চরকা কাটা বুড়ি,

অথবা হয়ে রাজপুত্র পক্ষিরাজে উড়ি।

কখনো আবার মন হতে চায় প্রজাপতির ছানা,

যখন খুশি উড়ে যেতে নেই তো কোনো মানা।

ঠাম্মি যখন রাতের বেলা ভূতের গল্প বলে

ইচ্ছে করে নাম দিয়ে দিই আমিও ওদের দলে।

গুপী বাঘার মতন পেলে ভুতের রাজার বর

যেতে পারি ফেলুদা বা বঙ্কুবাবুর ঘর।

মা বলেছে বই পড়লে সবই জানা যায়।

কোন বইতে লেখা থাকে এসব হওয়ার উপায়?

বাবা মায়ের স্বপ্ন আছে আমায় নিয়ে কত,

আমার মনের ইচ্ছেগুলো নয়তো তাদের মত!

তাসের ঘর_Sayan Kansabanik

। তাসের ঘর ।। 

প্রেম যেমন সুখের রাজপ্রাসাদ বানাতে পারে

ঠিক তেমনই এই প্রেমই মুহূর্তে তাসের ঘরের মতো

নিঃশব্দে ভেঙে দিয়ে যায়

নিজের শেষ অবলম্বন দিয়ে বানানো সুখবাড়িটা।

আমরা শুধুই প্রেমের কাছে ক্ষণিকের অতিথি মাত্র।

‘আমার’ বলে কিছু হয়না পৃথিবীতে।

যতক্ষণ আমরা ভালো থাকি ততক্ষণই সুখ আমাদেরই অধিকৃত।

নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার পর একমুহূর্তও যেন একেকটা অসহনীয় অধ্যায়

যার শুরু থাকলেও শেষ জানা নেই।

কাছের মানুষটা যখন সবকিছুকে ভাসিয়ে দেয় নিয়তির পথে,

তখন ভাগ্যেরও পরিহাস করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকেনা।

তারপরেও কিছু অনুভূতি থেকে যায়

বিপর্যয়ের কালো মেঘের অন্তরালে ঘনীভূত কালশিটের মতো।

এদের কোনো নাম হয়না,ঠিকানা হয়না,হয়না কোনো আগলে রাখার মতো মানুষ।

দগ্ধে যাওয়া এই মনের বিতৃষ্ণায় মরে যায় একদা সবুজ স্বপ্নগুলো।

সব ছাই উড়িয়ে অমূল্যরতন পাওয়া যায়না।

কিছু চোখের জল হয়ে ঝড়ে পড়ে। 

যেই ইচ্ছেরা কোনো এক পরিযায়ীর হাত ধরে ডানা মেলতে চেয়েছিল অনন্ত আকাশের বুকে

তারা হঠাৎই নিঃসঙ্গ হয়ে যায়,

সেই বুকেই এসে বেঁধে অভিযোগ,দোষারোপ আর ব্যর্থতার শানিত তীর।

রক্ত ক্ষরিত হতে হতে রক্তের শেষ বিন্দুটুকুও

তৃষ্ণার্তের মতো গুমরে ওঠে অতীতের বিষণ্ণতায়।

তারপরেও আমাদের একটা ছাদ হয়,আমাদের যত্নে বেড়ে ওঠে একটা জুঁই চারা।

সব অতীত ভুলে আমরা আবার ‘ঘর ঘর’ করে মরি।

কিন্তু একটা ঘর মানুষকে কতোটাই বা আশ্রয় দিতে পারে,

যদি না ঘরের মানুষটাই আপন হয়!

নাম: সায়ন কংসবনিক

ঠিকানা: নবদ্বীপ

ফোন: 9775169985

ReplyForward

খোকার মা_Plaboni

খোকার মা 

আমি মৃণালিনী সেন,

কিন্তু পাড়ায় সবাই চেনে খোকার মা বলে।

এতএত বছর আমি নিজের পরিচয় ভুলেই গিয়েছিলাম,

শুধু “খোকার মা”আমি এটা মনে রাখতাম।

জানো আমার খোকা সময়ের আগে জন্মেছিল,

“এ ছেলে বাঁচবে না”ডাক্তার বলে দিয়েছিল।

আমি পণ নিয়েছিলাম খোকাকে আমি বাঁচাবো।

খুব তো পয়সা ছিল না আমাদের,

তার উপর জাঁকিয়ে বসেছিল অভাব ও।

ধার করে দুধ আনতাম আমার খোকার জন্য,

আরো কতকিছু যাতে আমার কোল না হয় শূন্য।

বেশি দিন এভাবে চলল না,

দেনা করতে করতে একদিন সব চলে গেল,

আশ্রয়টুকুও আর থাকলো না।

আমাদের ঠিকানা হলো রেলের বস্তিতে,

কিন্তু জানিস খোকা,

তোকে সঙ্গে নিয়ে থাকতাম খুব স্বস্তিতে।

আস্তে আস্তে তুই বড় হলি,

প্রাণটা জুড়িয়ে যেত শুনে তোর মুখে আধো বুলি।

ছোট থেকেই তোর পড়ার প্রতি খুব টান,

মনে আছে খোকা তুই বলতিস,

আমি বাড়াবো তোমাদের মান।

রাতে যখন ট্রেনের শব্দে ভয়ে উঠতিস কেঁদে,

আমি দুই হাতে তোকে বুকের মধ্যে নিতাম বেঁধে।

তুই বলতিস “মা” বড় হয়ে

আমি তোমায় নতুন বাড়ি দেবো,

তুমি,আমি,বাবা একসঙ্গে সেখানে থাকবো।

দেখতে দেখতে মাধ্যমিক দিলি,উচ্চমাধ্যমিক দিলি,

সেখানে ভালো নম্বর পেয়ে

স্কলারশিপের টাকায় কলেজে ভর্তি হলি।

তার কিছুদিন পর তোর বাবা গেল চলে,

তুই তখন আমার একমাত্র আশা হোলি।

বিয়ে করলি নিজের পছন্দমত,

আমাকে জানালে খুব কি ক্ষতি হতো।

একদিন এলি ঠিক-ই আমার এই ছোট্ট ঘরে,

তবে তোর সব জিনিস নিয়ে যাবার তরে।

বললি,”তোমার জন্য নতুন ঘর ঠিক করেছি

চলো তোমাকে সেখানে রেখে আসি”।

ভাবলাম তুই নিয়ে যাবি তোর আর বৌমার কাছে,

কিন্তু একি!এখানে তো দেখছি বৃদ্ধাশ্রম লেখা আছে!

খোকা,তোকে বড় করার দাম এভাবে দিলি,

আমাকে এতটাই পর ভেবে নিলি।

আজ বারো বছর হলো তোকে দেখিনা,

তোর মা-কে একটুও মনে পরেনা?

আয় না খোকা একবার তোর মায়ের কাছে,

দুচোখ ভরে দেখবো যতদিন দেহে প্রাণ আছে।

তুই না খেয়ে দৌড়বি সারা ঘরময়,

বিশ্বাস কর খোকা তোকে কাছে পেতে বড্ড ইচ্ছা হয়।

শুনেছি তোর ছেলে হয়েছে,কি নাম দিলি?

তাকে তার ঠাম্মার কথা কক্ষনো বলেছিলি?

তোর ফ্ল্যাটে আমার কোন ছবি আছে?

খোকা,তোর বৃদ্ধ মায়ের কোনো স্মৃতি মনে আছে!

আমি এখানকার সবাইকে বলেছি,

তুই একজন ডাক্তার,

ওরাও তোকে দেখতে চেয়েছে একটি বার।

জানিস আজ আমি বিছানায়,বুকে খুব ব্যথা,

এখানকার সবাই ভেবেছিলো 

তোকে জানাবে আমার কথা।

আমার খোকা একজন ডাক্তার,তবু হায়!

আজ আমি মরতে চলেছি বিনা চিকিৎসায়।

আমি ওদের বলেছি

আমি মারা গেলে তোকে যেন খবর দেয়,

তুই তখন একটু আসিস যে কোনো বাহানায়।

চিরকাল তুই থাকবি আমার হৃদয়ে,

আর আমি বাঁচবো আমার “খোকার মা” হয়ে।

                                                            ইতি-খোকার মা

সাদা ক্যানভাস_Madhurima Banerjee

সাদা ক্যানভাস

সাদা ক্যানভাসের ফাঁকে আলপনা খোঁজে রোহিত,

সেদিন নীল জামা পরে এসেছিল স্যানোরিটা।

ফাঁকা ক্যানভাসে নীল রং ঢেলে কেউ কি করেছে মোহিত?

স্যানোরিটার গালে টোল , নাকি সে আজ অ্যাংরিটা?

নন্দনে ৪টের শো নাকি মধুসূদন মঞ্চের নিয়ন আলো

রোহিত ভাবতে থাকে কোনটা তার মন করে ভালো।

ঐন্দ্রিলা, দীপান্বিতা, মালবিকা, খুঁজে চলে ক্যানভাসে নানা মুখ

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, আসলে কোনটা সুখ?

রাতের নগরী আরও পসরা সাজিয়ে যখন নিভৃতে

রোহিত ভাবে স্যানোরিটা দেখা দেবে নাকি অফবিটে?

মেয়ো রোড ধরে হাটতে হাটতে চিন্তায় ছেদ পড়ে

ময়দান বড় মন টানে আজ ক্যানভাসখানি ছেড়ে।

সাদা ক্যানভাস একলাই থাকে যেন বোবা, কালা,

জুঁই ফুলের গন্ধটা দিয়ে হোক না গলার মালা।

স্যানোরিটা করে মন শুধু উদাস বাউল হয়ে

আসবেনা কি কোনওদিন অপেক্ষায় সময় যাবে বয়ে?

রাত ৯টা বাজে, বোঝা গেল সোহাগিনীর উত্তর

লিখতে পারলনা আসবেনা বলে একটা শুধু পত্তর।

পার্কস্ট্রিটের প্রিয় বেকারীর শীতের গন্ধের কেক

এনেছিল ভেবে খুশি হবে প্রেয়সী, আসলে সব ফেক।

হঠাৎ দূরে মনে হল কলরোল যেন বেশী

অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে দূরে, কোনও এক এলোকেশী।

ভিড়ের বলয় কাটিয়ে, হাতের আংটি রোহিতেরই দেওয়া

স্যানোরিটা শত যোজন দূরে, আর যাবেনা পাওয়া।

সাদা ক্যানভাস সাদাই রইল নীল রং আজ ফিকে

রোহিত হাঁটছে, আলো নিভছে, অন্ধকার চারিদিকে।

ফেরা না ফেরা_Sankar Bramha

ফেরা না ফেরা

শংকর ব্রহ্ম

—————————————-

(এক).

           চদ্রনাথ রায় সারা জীবন ধরে একটি বৃক্ষ খুঁজে চলেছেন। যার শীতল ছায়ায় শুয়ে বসে, আনমনা হয়ে, কেবল কবিতা লিখে যাবে মন-প্রাণ দিয়ে, সারা জীবন ধরে। মনে মনে সত্যিই কবিতাকে খুব ভালবাসত, সে তাই চেয়েছিল কবিতাকে নিয়ে সারা জীন থাকতে। অনেক কবিতাই সে লিখেছিল তার মধ্যে সবগুলােই যে কবিতা হয়ে ওঠেনি, তা সে নিজেই বুঝতে পারত , এমন কি লেখার সময়ও, তবুও সে লিখে যেত প্রাণের আবেগে। কবিতা লিখতে তার কতই না ভাল লাগত, আনন্দ হত। এই জীবনটাই তার ভালাে লাগত। মান সম্ভ্রমের তেমন কোন আলগা বালাই নেই, তেমন কোন গুরু-দায়িত্ব নেই, থাকার মধ্যে আছে এক নির্ভেজাল দারিদ্র। ছেঁড়া চটি পায়ে, যে কোনও একটা জামা গায়ে, সেটা জীর্ণ পুরণো হােক তাতে কোন ক্ষতি নেই। তারপর একটি গাছের তলায় শুয়ে বসে কেবল কবিতা লেখা। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে জীবনে, সে ভাবত মনে মনে ?

    বসিরহাট মাধ্যমিক স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে চন্দ্রনাথ প্রথম কলকাতায় মামার বাড়িতে

থেকে পড়তে এসেছিল। প্রয়ােজনীয় বই-পত্তর পড়াশােনা  তার পড়তে ভালাে লাগত না তেমন, যত ভাল লাগত নতুন কবিদের লেখা কবিতার বই, সদ্য প্রকাশিত কবিতা পত্রিকা পড়তে। ফলে

কোনও মতে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলেও, কলেজে পড়া আর হয়ে ওঠেনি তার।

তারপর অনেক বছর পার হয়ে গেছে। সে এখন একজন সফল সাংবাদিক।

  সাংবাদিকতার বিষয়ে তার বইও বেরিয়েছে, নাম করেছে সেই বই । কিন্তু কবিতার কোনও বই বের হয়নি আজও তার। এটাই মনে দুঃখ তার।

    তিনি তার মনের একান্ত বাসনার কথা সেদিন আমার কাছে বলেছিলেন। আমরা একটা বারে বসে মদ্যপান করছিলাম। মনের গােপন বাসনার কথা বলে সে তৃপ্তি বােধ করেছিল। কবির অলস জীবন-যাপন, স্বাধীন- চলা ফেরা,তার রােমাঞ্চকর মনোবাসনার কথা যারা শুনতে চায় তাদের কাছে বলে সে হালকা বোধ করত। যারা শুনতে চাইতো না, তাদের কাছে বলেও।

বলেও সে স্বস্তি বােধ করত। কেউ কেউ বিরক্ত হতো ঠিকই। তাতে কিছু আসত যেত না তার। বলাটাই যেন তার কাজ। কেউ শুনুক আর না শুনুক।

  সাংবাদিক চন্দ্রনাথ রায়, চাঁদু দা নামেই সকলের কাছে পরিচিত। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, আমার স্ত্রী স্নিগ্ধা যেদিন আমাকে লাথি তাড়িয়ে দিয়েছিল, সে’দিনটা ছিল আমার জীবনে সত্যিই একটা শুভদিন। কী এক অব্যক্ত যাতনায়, তীব্র আক্রোশে সে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। 

             সেদিন একটি কবিতা লিখেছিলাম –

‘দুপুর রােদের মাঠ পেরোলেই বন্ধু পাবে

প্রিয় সাথীর সঙ্গে তোমার দেখা হবে

সে-ই তোমায় পৌঁছে যাবে বার-দুয়ারী 

বার-দুয়ারী পৌঁছে গেলেই মনের ভিতর গড়ের মাঠ

তুমিই তখন হাসতে হাসতে গড়ের বিশাল মাঠ পেরোবে

প্রিয় নারীর সঙ্গে তােমার দেখা হবে শেষ বিকেলে, 

রোদের নিকেল ফুরিয়ে গেলে

তুমিই তখন খেলার ছলে প্রেম শেখাবে প্রেমিকাকে

হঠাৎ আবেগ, তীব্র বেগে বুকের ভিতর টানবে তাকে।

বার দুয়ারী, প্রিয় নারী এসব ভাল

তার চেয়েও আরও ভাল দুপুর রােদের নিকেল আলাে,

সবার চেয়ে বেশী ভাল-

দুপুর রােদের মাঠ পেরনাে প্রিয় তােমার বন্ধুগুলো।’

          কবিতা শুনে বন্ধুদের অনেকেই সমাদর করেছিল। ফলে মনে একটা চাপা আনন্দ

প্রবাহ তৈরী হয়েছিল। সেই আনন্দ প্রবাহ মনে ধরে নিয়েই, আনন্দে বাড়ি ফিরে এসে আমি স্নিগ্ধাকে আদর করে জড়িয়ে ধরে, কবিতাটা শোনাতে চেয়েছিলাম। ঠিক তখনই ও জলন্ত দৃষ্টিতে আমাকে পুড়িয়ে হাই করে দিতে চেয়েছিল। 

“তীক্ষ্ণ শব্দ-বাণের”বেগে আমাকে ঘায়েল করে, বুকে নুড়োর জ্বালা জ্বেলে আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। তার ধাক্কায় বুকের পাঁজরে তীব্র খোঁচা লেগে, ব্যথায় অবশ করে উঠেছিল, কিন্তু তার চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম মনে, মনের গভীরে। মনে হয়েছিল, স্নিগ্ধা আমাকে সেদিন বেওয়ারিশ কুকুরের মতাে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন। 

আজ মনেহয় সেদিন হয়তো সে আমাকে উচিৎ শিক্ষাই দিয়েছিল। তা’তে আমার সম্বিৎ ফিরে এসেছিল। যেন দীর্ঘ ঘুমের পর হঠাৎ স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠে ,জাগড়ণের পর যেন অপার বিস্ময়ে ,  অকস্মাৎ এই আঘাতে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম। হ্যাঁ সত্যিই নিজেকে খুজে পেয়েছিলাম সে’দিন, সম্পূর্ণ একা নিঃসঙ্গ। 

       সিন্ধার ফেলে যাওয়া সংসারে বিমুঢ় হয়ে, নির্বাক সারা রাত সােফায় বসে কাটিয়ে দিয়েছিলাম শুধু। বিশেষ কিছুই ভাবিনি। তবে দৃঢ় সংকল্প করে ফেলেছিলাম, আর কবিতা নিয়ে মেতে থাকা চলবে না। এক প্যাকেট সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল সে রাতে।

    একদিন ভেবেছিলাম , রবীন্দ্রনাথ না হতে পারি কবি প্ৰাণনাথ হতে বাধা কোথায়? সেদিন সে আশা নির্মমভাবে, চিরতরে জলাঞ্জলি দিয়ে মন স্থির করে ফেললাম, এবার থেকে এমন কিছু করতে হবে যাতে রুটি রুজির ব্যবস্থা হয়।

ভােরের আলাে চোখে পড়ায় সম্বিৎ ফিরে এলো। বলা যায় ঠিক ওই দিন থেকেই সাংবাদিকতাকে

জীবিকা হিসাবে ধরে, তাকে ভর করে উঠে  দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম। সেদিন কেন সাংবাদিক হব ভেবেছিলাম, তা আজ আর ঠিক মনে নেই। হয়তো ভেবেছিলাম, ‘সাংবাদিকতা’ কাজটির গালভরা নাম স্নিগ্ধাকে কিছুটা স্বস্তি দেবে মনে।

        হ্যাঁ, যা ঘটবার তা মানুষের জীবনে হঠাৎ করেই ঘটে যায়,পিছনে তার কার্য কারণ আর যা-ই থাকুক।

         সিগ্ধা আমাকে অপদার্থ, নিষ্কর্মার টেকি, মুরােদ নেই কোন কাজের, কত কিছুই বলেছে। কিন্তু সেদিনের মতো এমনভাবে কোনওদিনই ও কথাগুলাের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারিনি।

স্নিগ্ধা একটা হাইস্কুলে পড়াত, শিক্ষা-দীক্ষা রুচিতে আমার চেয়ে হয়তাে উঁচুতে ছিল। ফলে, আমার ভিতর একটা হীনমন্যতা কাজ করত সব সময়। বলে গ্লাস শেষ করলেন চাঁদু-দা।

(দুই).

        বিশ বছর কবিতা লিখে কিছুটা নামডাক হয়েছে আমার। কয়েকখানা বই বেরিয়েছে, কলেজ-স্ট্রীটের প্রকাশনী থেকে। পুরস্কার-টুরস্কার জুটেছে দু-একটা। সরকারি বে-

সরকারি অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠের ডাক পাই। তাই আজকাল বার দুয়ারী বা খালাসীটোলার বাংলা মদের ঠেকে যেতে রুচিতে বাধে। ও সব জায়গায় সস্তায় লোকেরা মদ খেতে যায়। চ্যাংড়া ছােকড়াদের হৈ হট্টোগোল মাতামাতি লেগেই থাকে।

 আজকাল ট্রিংকাস বা ব্লু ফক্সে যাই আমি ড্রিংঙ্ক করতে (মদ খেতে নয়)। সেখানেই চাঁদুদার সঙ্গে দেখা। তার সঙ্গে কবে কোথায় পরিচয় হয়েছিল ঠিক মনে নেই। তবে কোনও অনুষ্ঠানেই সম্ভবতঃ আলাপ হয়ে থাকতে পারে মনেহয়।

    তিনি ছিলেন সকলেরই চাঁদুদা। আমিও তাই বলে ডাকতাম।

(তিন).

চাঁদুদা বললেন, আর এক পাত্র করে হুইস্কি হয়ে যাক। কি বলেন?

আমি সায় দিয়ে বললাম, তা, বেশ তাে, আপত্তি কিসের ?

        চাঁদুদা বয়কে ডেকে দু-পেগ হুইস্কির অর্ডার দিলেন। তারপর নড়েচড়ে একটু সােজা হয়ে বসলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, স্নিগ্ধার শিক্ষাদীক্ষা রুচি কোনওটাই ওর কিছু ফেলনা ছিল না। ও এমনিতে হাসি খুশি মধুর স্বভাবের ছিল। কিন্তু, ওর সেই রসবােধ ওর জীবনে সত্যিকারের কোনও কাজে লাগেনি। অপ্রীতিকর পরিস্থিতির হাত থেকে ওকে নিস্তার দিয়ে, পেতে পথ দেখাতে পারেনি। পােশাকের অতিরিক্ত ঝালরের মতাে শুধু শােভাই বাড়িয়েছে, প্রয়ােজনের সময় কোনও কাজেই লাগেনি।

      স্নিগ্ধা যে খুব বেশি সুন্দরী ছিল তা নয়। তবে তার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল, যা আমাকে খুব আকর্ষণ করত। এক-এক সময় তার বিভিন্ন ভঙ্গি আর মনের বিশেষ অবস্থায় দিকে তাকালে, বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠত আমার। কবি সত্তা জেগে উঠত মনে। সে সময় অতি সাধারণ তুচ্ছ ঘটনাও আকর্ষণীয় হয়ে উঠত আমার চোখে।

       তবে, একসঙ্গে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বাস করা সােজা কথা নয়। এতে সঙ্গীর মন্দ দিকটা বেশী করে প্রকট হয়ে পড়ে। ভাল দিকগুলাে হারিয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। তিন বছর এক সঙ্গে কেটেছে আমাদের। আজও মাঝে মাঝে হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠলে, তীব্র আক্রোশে, আর রাগে মনে হয়, কেন ওকে বিয়ে করে জীবনের মূল্যবান তিনটি বছর এমনভাবে নষ্ট করলাম। সবটাই অপচয় হয়েছে আমার জীবনের।

    সত্যিই ও খুব শক্ত ধাঁচের মেয়ে ছিল। নারীর সুলভ সহজাত মাধুর্য ওর মধ্যে কিছুই ছিল না। সে মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দিত, আমি যদি পঙ্গু হতাম, তা হলে ও আমার ভরণ পোষণ আনন্দে বহন করতো। আমার জন্য কাজ করে খাওয়াতো , আমার সেবা যত্ন করত। কিন্তু যে আমি সুস্থ সবল হয়েও চাকরির কোনও খোঁজ করি না, তার জন্য ও কিছুই করতে পারবে না,পারলেও করবে না। ও আমাকে সবসময় বলত, অপদার্থ, নিষ্কর্মার-টেকি। ওর জীবন আমিই ব্যর্থ করে দিয়েছি ! আরও কত সব শক্ত শক্ত হুঁল ফোটানাে কথা,  ‘বিষ-মাখা ধাঁরালো’ তীরের মতাে।

ওর ধারণায় অসভ্য বর্বর কতগুলো লােক – আমার বন্ধু হিসাবে আমার বাড়িতে আসত।

নিয়মিত যাতায়াত করত তা’রা।  তা ও মোটেই পছন্দ করত না। সহ্য করতে পারত না ওদের। আমি ওকে বােঝাবার চেষ্টা করলাম, এরা কেউ শিল্পী, কেউ কবি! ও স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিল, ও একদম ওদের বরদাস্ত করবে না।

আমি বলতাম, ওরা সব প্রতিভাবান, স্রষ্টা। 

স্নিগ্ধা তা শুনে বিদ্রুপ ব্যঙ্গ করে বলতো, ছাড়ো তাে ওসব হেঁদো কথা। এ’সব নিয়ে প্রায়ই ওর সঙ্গে সঙ্গে তর্ক বিতর্ক হতো আমার । ও শ্লেষের সুরে বলতো,

– আহা রে  কী আমার কবি? ও কেন পােশাক বদলায় না? রোজ দেখি একই পোষাক পরে আসে। স্নিগ্ধা প্রশ্ন ছুঁড়তাে আমার কাছে।

আমি বলতাম, হয়তাে ওর আর কোন পোশাক নেই।

– শিল্পী কেন এত পেটুক, খাবারের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো।

আমি বলতাম, হয়তাে পেট ভরে খেতে পায় না ঘরে।

স্নিগ্ধ কিছুতেই সেটা মানতে চাইলে না। 

কেবলই একই প্রশ্ন করে চলতো , তবে কেন ওরা যে কোন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে না। খেতে না পেয়ে , মরে গেলে শিল্প দিয়ে কি হবে ওদের?

শিল্পীর জীবনে দারিদ্র যে নিত্যসঙ্গী সে কথা

 ওকে কিছুতেই বােঝানাে যেত না। ও তা মানতে চাইতো না।

ও বলত, তা হলে আমি বলতে পারি, এ দারিদ্র, শখের দারিদ্র। সাধ করে দারিদ্র ভোগ করা।

        তাই আমার বন্ধু শিল্পী কবিদের দু’চোখে দেখতে পারত না স্নিগ্ধা। ওকে আমি বােঝাতে চেষ্টা করেছিলাম, এই সব শিল্পী কবিরা জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দের তােয়াক্কা না করে, হৃদয়ের আর্তির  কাছে নিজেকে সঁপে দেয়। মনের চাহিদাটাকেই বড় করে দেখে। আর চিরজীবনের জন্য দুঃখ-কষ্ট-দারিদ্র স্বেচ্ছায় তা মেনে নেয় মনের আনন্দে।

স্নিগ্ধা শুনে বলত, ” ফুঃ। যত সব বাজে কথা।

ওরা শুধু বড় কোন সুযোগের অপেক্ষায় আছে। তোমার  মতো কেউ বোকা নয় ওরা , সে আমি ভাল করেই জানি।”

         ও ঠিক কথা বলেছিল। ওর কথাগুলি প্রকাশ্য দিবালোকের মতোই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল কিছু দিনের মধ্যেই।

       শিল্পী এক ধনী বিধবাকে বিয়ে করে, বিদেশে পাড়ি দিল তার ছবির প্রদর্শনী করতে। 

      কবি সরকারি একটা চাকরী পেয়ে কবিতা লেখা ভুলে গেল। এখন আর কবিতা লেখে না। বেশ সাচ্ছন্দে আছে জীবনে। শুনেছি, এক ধনীর মেয়েকে বিয়েও করেছে সম্প্রতি। ঘোরতর সংসারী সে এখন। কবিতা লেখার সময় হয় না আর তার।

          বেয়ারা দু’পেগ হুইস্কি  আমাদের গ্লাসে ঢেলে দিয়ে গেল। সোডা মিশিয়ে চাঁদু-দা ছােট্ট চুমুক দিলেন, তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘বিযের পর প্রথম প্রথম স্নিগ্ধা মুখে কিছুই বলত না। কিন্তু দিনের পর দিন কিছু কিছু ব্যাপারে সে অখুশী হতে শুরু করল। প্রথম কয়েক সপ্তাহ তাে মাঝে মাঝেই কাঁদত। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতে পেতাম, নিরুপায় কান্নায় আকুল হয়ে উঠেছে সে।

সকালে উঠে বসে চা খেতে খেতে, মাঝে মাঝে হাতে মাথা রাখে, কাঁদতে শুরু করত।

আমি প্রশ্ন করে তার কারণ জানতে চাইলে ও শুধু বলতো, ও কিছু না। আমার কি হয়েছে ছাই, আমিও কি বুঝি নাকি? শুধু কান্না পায়, তাই কাঁদি। ওর এ’রকম মনােভাব অবশ্য বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। কিন্তু তা’তে স্বপ্ন-ভরা রাতগুলি আমাদের বিষিয়ে গেল।

         স্নিগ্ধার , ও রকম অদ্ভুত আচরণের এখন অবশ্য আমি কারণ বুঝি। ও আমার বন্ধুদের

এক পছন্দ করত না। ধীরে ধীরে আমিও অসহ্য হয়ে উঠলাম ওর কাছে। মনের  মতো করে ওকে আমার গড়ে তোলার  আর কোন উপায়ই রইল না।

         বিয়ের আগে আমি কত স্বপ্ন দেখেছিলাম।

মনের মতােন করে ওকে গড়ে তুলব। তার আর কোনও উপায় রইল না। বিয়ের আগে আমি ভেবেছিলাম ওর নিরাপদ ছায়ায় আমার কাব্যচর্চা ব্যপ্তি পাবে। প্রসারিত হবে বৃক্ষের ডাল-পালার মতো। তা আর হয়ে উঠল না।

সারা জীবন ধরে আমি একটা গাছ খুঁজেছিলাম। যার শীতল ছায়ায় আনমনে শুয়ে বসে নিজের মনে কেবল কবিতা লিখে কাটিয়ে দেব। স্নিগ্ধাকেও কী সে’রকম কোন গাছ ভেবেছিলাম আমি? হয়তো তাই ভেবেছিলাম। জানি না ঠিক।

     স্নিগ্ধা চলে গিয়ে, না জেনে বুঝেই বড় উপকার করে গেছে আমার। অবশ্য ভেঙে  চুরমার করে দিয়ে গেছে আমার কবি হবার স্বপ্ন। যা’র হওয়ার কথা ছিল কিনা , এ যুগের এক বিশিষ্ট কৰি।   

       আজ সে হয়ে গেল একজন সাংবাদিক মাত্র।

   কাপুরুষের মতো একটা ভীতি সর্বদাই আমার মন জুড়ে ছিল, এই বিবাহ বুঝি অচ্ছেদ্য বন্ধন। পরিণামে যতি খারাপই হোক, যতই তিক্ততাই আসুক, যতই নিষ্ঠুরতাই থাকুক, সব সহ্য করতে হবে আমাকে। তবু যেন নির্বিকারভাবে, একজনের আর একজনকে ভালােবাসতে হবে আমরণ । 

শেষ দিকে আমারও ওকে অসহ্য মনে হতাে। ওর

কাছে সত্যিই আজ খুব কৃতজ্ঞ আমি,ও আমায় ছেড়ে না চলে গেলে , হয়তাে ভবঘুরে হয়েই থাকতাম সারাটা জীবন। কবিতা লিখবার চেষ্টা করে সময় নষ্ট করতাম।

    শহরের সস্তা চায়ের দোকালে কিংবা রবিবার সূতৃপ্তিতে বসে বক্তৃতা করতাম বাস্তবাগীস , চতুর, দারিদ্রলাঞ্ছিত শিল্পী কবিদের সঙ্গে আড্ডা মারতাম! যারা কিছু একটা নতুন সৃষ্টি করার আগ্রহে সমানে বকবক করেই চলেছে। এখনও ভাবি এরা সব সত্যিকারের কবি-শিল্পী একটুও ভেজাল নেই এঁদের মধ্যে। এঁরা কখনোই

নিজেদের বিকিয়ে দেয় না, এঁরা নিষ্কর্মা’ও  নয়। শিল্পের সাধনায় অবিরত শ্রম করে চলেছে। জাত শিল্পী সব।

        আমি বললাম নির্ভেজাল পবিত্র শিল্প।

আহা আমাদের গ্লাস আবার শূন্য হয়ে গেল যে।

চাঁদু দা বললেন।

আবার হুইস্কি এল। গ্লাস ভরে উঠল। চাঁদুদা গ্লাসে একটা ছােট চুমুক দিয়ে, আবার আবার বলতে শুরু করলেন,

      যে গাছের তলায় শুয়ে থাকার কল্পনা করেছি, স্বপ্ন দেখেছি, সে গাছটি আর খুঁজে

পেলাম না সারা জীবনে।

কাজে আর ভাবনায় কবি হওয়ার সাধনা আর কামনা নিয়েই এতদিন ছিলাম। সে স্বপ্ন চুরমার করে দিয়ে চলে গেল স্নিগ্ধা । কবি হওয়া আর হল না আমার । 

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো চাঁদুদার।

হলাম দৈনিক পত্রিকার ব্যস্তু সাংবাদিক। শুয়ে বসে কাটানাের অলস জীবন কোথায় হারিয়ে গেল? শেষে আপসোসের সুরে বললেন, আপনাদের মতাে কবিদের দেখলে, হিংসা হয় মশায়।

চাঁদুদা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আমি দেখলাম, চোখদু’টি তার কিছুটা

লাল আর দৃষ্টি ঘােলাটে। আমারও বেশ নেশা হয়ে গেছে।

– রাত কত্ত হল চাঁদু-দা? আমি জানতে চইলাম।

“ ওহ্ , আপনার তো আবার বাড়ি-ঘর, ,ছেলে ৰউ আছে। তাহলে চলুন ওঠা যাক। রাত কম হয়নি? বেয়ারকে ডেকে তাকে বিল মিটিয়ে দিলেন। আমিও কিছু দিতে চাইলাম। দিতে দিলেন না।

বেরিয়ে এসে রাস্তায় একটা ফাঁকা ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। চাঁদুদা জোর করে আমায় তা’তে তুলে দিয়ে বললেন,আপনি আগে যান কবি।

         বৌদি হয়তো আপনার ফেরার অপেক্ষায় বসে আছেন। আমি তো আজও ভুবঘুরেই রয়ে গেছি মনে মনে। কাজের সময় যত ব্যস্ততাই থাক, অন্য সময় আমার মতো নিষ্কর্মা আর খুব একটা বেশী পাবেন না ।

হা হা হা হা করে চাঁদু-দা মাতাল স্বরে হাসলেন।

– চলি, বলে আমি ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম। ট্যাক্সি চলতে শুরু করলাে। দেখলাম, দূরে দাঁড়িয়ে চাঁদু-দা হাত নাড়ছেন। যেন সে নিজেই একটা গাছ হয়ে, ডাক পালা ছড়িয়ে, অন্যকে ছায়া বিলােবার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন।

(চার).

          এরপর বহুদিন চাঁদুদা’র সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। প্রায় সাত আট মাস বাদে বইমেলায় হঠাৎ, দেখা হয়ে গেল , তার সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিন প্যাভেজিয়ানে।

          বেশ খুশ মেজাজে আছেন দেখলম।

আমি বললাম, কি ব্যাপার চাঁদুদা, এতদিন দেখিনি কেন আপনাকে? বাইরে কোথায়ও গেছিলেন নাকি সাংবাদিকতার কাজের প্রযোজনে?। 

– উত্তর-বঙ্গে গেছিলাম।

– কেন, কোন কাজ?

– হ্যাঁ, মানে না, তেমন কোন কাজ নয়। আবার জরুরী কাজও বটে।

 চাঁদু-দা রহস্যময় ভাবে হাসলেন।

– মানে?  রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি একটা।একটু খুলে বলুন না, ব্যাপারটা..

– হ্যাঁ বলব,চলো আগে একটা কোন চা – কপির স্টলে গিয়ে বসি।

আমি বললাম, বেশ তাই চলুন তবে। 

ঘুরে ঘুরে বসার মতো একটা ফাঁকা স্টল খুঁজে পেলাম না। চাঁদু দা হেসে বললেন, এরা কি বই কিনতে আসে নাকি খেতেই আসে শুধু?

– আমি বললাম,কি জানি?

আমরা দোকান থেকে দু’কাপ কফি কিনে নিয়ে, মাঠে এসে পা ছড়িয়ে বসলাম।

ধোঁয়া-ওঠা গরম কফিতে চুমুক দিয়ে চাঁদু-দা বললেন, 

– স্নিগ্ধার কাছে গেছিলাম, ও ডেকেছিল। একবার দেখা করার জন্য বলেছিল। তাই

ওখানেই…

– বেশ সুসংবাদ তো। এরপর কি হল বলুন ?

      সেদিন বারে হুইস্কি খেতে খেতে স্নিগ্ধার সঙ্গে বিচ্ছেদের কাহিনি শুনেছিলাম, তখন

কল্পনাও করতে পারিনি, কিছুদিন বাদে বইমেলার মাঠে বসে কফি খেতে খেতে তাদের

মিলনের কাহিনী শুনব।

       চাঁদুদা মুচকি হেসে বললেন, জানেন কবি,

জীবনে যা ঘটবার তা আমকাই ঘটে যায়। স্নিগ্ধা কোনওদিন আবার ফিরে আসবে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবতেই পারিনি। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর, ওর লেখা একখান পােস্টকার্ড পেয়ে অবাক

হয়ে গেছিলাম। ওর বাপের বাড়ি ময়নাগুড়ি থেকে লেখা। বেশি কিছু লেখা ছিল না তাতে। একবার দেখা করার অনুনয় শুধু। তার বেশি কিছু নয়। ভেবেছিলাম, যাব না।

    যাব না ভেবেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত না গিয়ে থাকতে পারিনি কি। এক অপার কৌতূহল, আমাকে যেতে বাধ্য করেছিল। ভাবলাম, কি জন্য ডেকেছে স্নিগ্ধা ? পাঁচ বছরের মধ্যে একবারও তো এরকমভাবে কখনো চিঠি লেখেনি সে ? তবে কি ওর কোন বিপদ ? নাকি অসুস্থ সে? যাই একবার গিয়ে দেখে আসি। একসঙ্গে দুঃখে সুখে তিনটে বছর তাে কেটেছিল আমাদের।

যাই একবার দেখা করে আসি ভেবে, চিঠি পাওয়ার দু’দিন পর দিন রওনা দিলাম। এই দু’দিন যাব কি যাব না-এই করে দ্বন্দ্বে কোটছে আমার।

গিয়ে দেখলাম স্নিগ্ধা সুস্থই আছে, আমাকে দেখে সাদরে আপ্যায়ন করল।

নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসলো। শুনলাম, ওর বাবা মারা গেছেন। তারপর

থেকেই দাদা তার উপর মানসিক অত্যাচার শুরু করেছে। এখান থেকে তাকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে। বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো স্নিগ্ধা। এরপর ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলতে লাগল , আমি এখন ভীষণ একা একটু থেমে আরও বলল, সবকিছু ভেবেচিন্তে আমি এখন বুঝেছি আগের অনেক হাঙ্গামার জন্য আমি নিজেই দায়ী।

   তোমার সঙ্গে আগের সে’সব দুর্ব্যবহারের জন্য আমি এখন অনুতপ্ত। আমি এখনও তোমাকে ভালবাসি। আগেও বাসতাম।

তোমার কবিতা পড়ে, তোমার সঙ্গে আমিই তো প্রথম সেধে পরিচয় করেছিলাম। বিয়ের আগে তােমার সঙ্গে মিশে তােমাকে ভালােবেসেছিলাম। বেকার হওয়া সত্ত্বেও তোমাকে, বাড়ির সকলের অমতে, বিয়ে করেছিলাম। এ’সব তাে মিথ্যে নয়, তা তুমিও জান। আর তাই আজ বুঝেছি তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অসম্পূর্ণ। আমি আবার তােমার কাছে ফিরে যেতে চাই।

      স্নিগ্ধা চলে যাবার পর আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর কোনও দিন ও ফিরে আসতে

চাইলেও আমি কিছুতেই রাজি হব না। কিন্তু ওর চোখের জলের অসহায় ধারা, সে প্রতিজ্ঞ আমারভাসিয়ে নিয়ে গেল কোথায়।

স্নিগ্না আরও বলল, আমরা দুজনে মিলে সুখের সংসার আজও গড়ে তুলতে পারি, সে বিশ্বাস আমার এখনও আছে। চলে আসার পর তােমার সব লেখাই আমি খুঁজে খুঁজে পড়েছি। তােমার বইখানাও পড়ে ভালাে লেগেছে। কিনে ঘরে রেখেছি।  সময় পেলেই মাঝে মাঝে আমি তা পড়ি। আমি এখন বুঝেছি, তুমি নিষ্কর্মা বা অপদার্থ নয় মোটেও।

চাঁদুদার কথা শুনতে শুনতে কখন কফির কাপ শেষ হয়ে গেছে।

চাঁদু দা বললেন, কফি আর এক কাপ করে হয়ে যাক ।

আমি আপত্তি করে বললাম, না থাক । আপনি খেলে নিন আর এক কাপ।

চাঁদুদা বললেন, না তবে থাক।

আমি বললাম, তারপর ?

চাদুঁ দা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তারপর আর কি? সঙ্গে করে নিয়ে ফিরলাম স্নিগ্ধাকে।

এখন তাহলে আপনার কাছেই আছে সে ?

চাঁদু দা যেন শুনতে পাননি আমার প্রশ্ন। আমার সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে উনি বললেন, শেষপর্যন্ত স্নিগ্ধা তাে ফরলাে কিন্তু আমার কবিতা আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেল। সে আর ফিরে এলো না আমার কাছে।

– একটি গাছের অভাবে? আমি বললাম।

গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চাঁদুদা নিঃশব্দে করুণ হাসলেন।

অচেনা মুখোশের ভীড়ে_Sagarnil BasuRoy

অচেনা মুখোশের ভীড়ে

___________________

“আচ্ছা ঝকমারি! শখ বলে কি এই ধাপধারা গোবিন্দপুরেই পিকনিক করতে হবে না কি?” শীতকালের গ্রামের কাঁচা রাস্তায় সাইকেল রিকশার ঝাঁকুনিতে অস্থির হয়ে নিজের মনেই গজগজ করছিলাম, আর সুব্রতকে আশ মিটিয়ে গাল দিচ্ছিলাম! ব্যাটা থাকে কোথায় কেনিয়ায়। জঙ্গল দেখে দেখে এতদিনে তার আশ মিটে যাওয়ার কথা। সে কিনা কদিন ধরে নাছোড়বান্দা, “ভাই, দশবছর পর দেশে আসছি! ছেলেবউকে একটু গ্রামবাংলার দর্শন করাবো না বল্?” ওর উৎসাহের আতিশয্য যথারীতি সংক্রামিত হয়েছে আমাদের কজনের ছোট্ট বন্ধুমহলে। আর পড়বি তো পড়, যেহেতু অদ্যাবধি ব্যাচেলর, আর ডাক্তারী করি এই জেলারই হাসপাতালে, তাই আমার উপরেই দায়িত্ব বর্তেছে পিকনিকের জায়গায় গিয়ে আগে থেকে সব দেখেশুনে আসার! আসলে, স্পষ্ট কথায় কষ্ট নেই। আর মুখের উপর না বলতেও জানতে হয়, না হলে আমার মত ভুগতে হয় বৈকি! 

যাই হোক, কয়েকটা ছুটি পাওনা ছিল এমনিতেও। রোগী আর হাসপাতাল, এই করে বেশ হাঁপিয়ে উঠছিলাম। একটু বাইরের হাওয়া খাওয়াও হবে চিন্তা করে আমার ছোট ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়েই পড়লাম এক সকালবেলা। সুব্রত অবশ্য একটা স্পটের ঠিকানা পাঠিয়ে দিয়েছিল আগেই। কিছুটা আন্দাজে, আর বেশ কিছুটা একে ওকে জিজ্ঞেস করতে করতে চলতে লাগলাম। খান দুয়েক ট্রেন বদলে, রিকশায় কোমরের হাড়গোড় মোটামুটি নড়বড়ে করে, বহু কসরতের পর অবশেষে পৌঁছনো গেল নদীর ধারের নির্জন এক জমিদারবাড়ীতে। এটাই নাকি একেবারে আইডিয়াল গ্রামবাংলার থিম, সুব্রতর বিদেশিনী বৌ আর পুত্রের জন্য। যখন পৌঁছোলাম, ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে। টিমটিম করে পঞ্চায়েতের রাস্তায় দু একটা কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বললেও সেগুলো যে কতখানি আলো দিচ্ছে, আর কতটা অন্ধকারকে ডাকছে ঠিক বোঝি মুশকিল। ভাড়া মেটাবার সময় রিকশাওয়ালার মুখের দিকে তাকাতে কেমন যেন একটা ধাক্কা লাগলো হঠাৎ! স্টেশনের কাছ থেকে ওঠার সময় যদ্দুর মনে পড়ছে একটা জোয়ান মদ্দ লোকের রিকশায় উঠেছিলাম। এতো দেখছি এখন ষাট বাষট্টি বছরের কোনো বয়স্ক রিকশাওয়ালার মুখ! দাঁতগুলো বের করে সাগ্রহে হাতটা বাড়িয়ে আছে। একটু অপ্রস্তুত লাগলেও ব্যাপারটা মনের ভুলই ভেবে তাকে ছেড়ে দিয়ে প্রায়ান্ধাকার বাড়ীটার দিকে এগোতে পিছন থেকে রিকশাওয়ালার হাঁড়ির মত গলা এল:

– বাবু কি এথায় থাকচেন আতে (রাতে)?

ঘাড় ঘোরাতে দেখি সে ইতিমধ্যে গলার মাফলারটা গোটা মাথায় মুখে এমনভাবে জড়িয়েছে, যে আধা অন্ধকারে তার মুখই দেখা যাচ্ছে না ভালো করে। জবাব দিলাম:

– “না না, কথা বলে ফিরে যাবো! কেন, রিকশা পাবো না? 

– আজ্ঞে, তা পাবান নে বোদয়। হেথায় আতের দিকে কেউ আসতে টাসতে চায় নে তো তেমনি!

– তাহলে? এতটা হেঁটে যেতে হবে? অনেকটা রাস্তা তো ভাই!

– আপুনি বললে ঘট্টা (ঘন্টা) খানেক হেথায় দেঁড়াই?

– ও বাবা, তাহলে তো খুব ভালো হয়। তুমি ভাই দাঁড়াও বুঝলে, আমি এই আধঘন্টার মধ্যেই আসছি! কথা বলেই! 

– আসুন আজ্ঞে। মু দেঁড়াই।”

যাক্, একটা বড় ঝামেলা মিটলো। প্রথমে না ভাবলেও নামার পর দুশ্চিন্তা হচ্ছিল এই অন্ধকারে স্টেশনে নিরাপদে ফেরৎ যেতে পারব তো সময়ে? রিকশাওয়ালাটাকে বেশ ভালোই মনে হল। যাইহোক, এসেই যখন পড়েছি, তখন বাড়ীর মালিকের সাথে একটুখানি কথা বলেই তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে! চুলোয় যাক গ্রামবাংলার শোভা, সুব্রতকে জানিয়ে দেবো লোকেশন পছন্দ হয়নি। এই নির্জনে সাধ করে আসে কেউ? রামোঃ। মাথায় থাক আমার পিকনিক। আর কি বিশ্রী ধুলো রে বাবা!

আধভাঙা সিংহদরজাটার একদিকের পাল্লাটা সরিয়ে ভিতরে ঢুকতে বেশ ঠান্ডা লাগলো হঠাৎ। সঙ্গে টর্চ ছিল। আলোটা ফেলতে একটা ছোট বাগান, বা বলা ভালো জঙ্গুলে কিছু ঝোপঝাড় দেখতে পেলাম। সেগুলো পেরিয়ে আরো এগোতে দেখি বাড়ীর সদর দরজা পুরোটা হাট করে খোলা। ভিতরে আবছা একটা আলোর আভাস মতও যেন দেখা যাচ্ছে বোধ হল। তারপরই দেখি চাদর মুড়ি দিয়ে একট, ছোকরামত লোক ছোট একটা হ্যারিকেন লন্ঠন হাতে আমার দিকেই হেঁটে আসছে। সে কাছে আসতে তাকে প্রশ্ন করলাম:

– “এ বাড়ীটা ভাড়া দেওয়া হয় শুনলাম, ঐ পিকনিক টিকনিকের জন্য আর কি। এখন কথা বলা যাবে তো? অনেকদূর থেকে আসছি!

– কিসের জন্যি কইলেন? ভাড়া নিবেন?

– পিকনিক…মানে, মানে… আমরা ঐ ইয়ে বনভোজন করব..

– অ, মালিক থে দেখা করবেন? আসেন।”

কথাটা বলেই লোকটা, খেলনা পুতুল যেমন ঘোরে, ঠিক সেইভাবে উল্টোদিকে ঘুরে লন্ঠনটা হাতে নিয়ে চলা শুরু করল। কি আর করি, আমাকেও তার পিছু নিতে হল অগত্যা। বেশ দ্রুতই হাঁটছিল সে। সত্যি বলতে বিনা কারণে এত জোরে হাঁটার অভ্যাস সত্যিই আমাদের নেই। লোকটার সঙ্গে তাল রেখে চলতে তাই বেশ অসুবিধাই হচ্ছিল। আর কি দীর্ঘ এই পথচলা! মনে হচ্ছিল যেন ধূসর অন্ধকারের মধ্যে পরের পর মহল, পেরোচ্ছি তো পেরোচ্ছিই। আমার সঙ্গীর হাতে ধরা ঐটুকু লন্ঠনের মৃদু আলো ব্যতীত এতবড় প্রাসাদের কোথাও এতটুকুও আলো দেখতে পেলাম না। আর সেইরকমই চাপা নৈঃশব্দ। দুএকবার চেষ্টা করলাম লোকটাকে জিজ্ঞাসা করতে, যে এতবড় বাড়ীতে ইলেকট্রিসিটি আছে, কি না!  কিন্তু মনে হল সে যেন ইচ্ছে করেই আমার কথাগুলো শুনেও না শোনার ভান করল। ঘন অন্ধকারে বাড়ীটার তেমন কিছু দৃষ্টিগোচর না হলেও শুধু এটুকু বারবার মনে হচ্ছিল, যে এই ভগ্নপ্রায়, ধূলিধূসরিত বিপুলায়তন অট্টালিকা খুচরো কোনো পিকনিকের জন্য তো নয়ই, বরঞ্চ যেকোনো বিগ বাজেটের হরর মুভির আউটডোর লোকেশন হিসাবে আদর্শ !! 

বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে/হোঁচট খেয়ে শেষমেশ আমরা বাড়ীটার এমন একটা অংশে এসে পড়লাম যেটা নদীটার একদম মুখোমুখি অবস্থান করে। লম্বা লম্বা পাথরের থামওয়ালা একটা টানা বারান্দা দিয়ে তখন আমরা হাঁটছিলাম। সারাদিনের মধ্যে এই প্রথমবার আমার মনটা সত্যিকারের ভালো লাগলো। বস্তুত এতক্ষণের দীর্ঘ ও বিরক্তিকর জার্নির ক্লান্তিতে এবং ধুলো আর অন্ধকারের সহাবস্থানের জেরে বাড়ীটার উপর আমার যে তীব্র বীতরাগ জন্মাচ্ছিলো, শীতের আমেজে ও নদীর হাওয়ায়, সাথে বিরাট জলবক্ষের আবছায়া দৃশ্যপট নজরে আসাতে সেটা যেন অনেকটাই কেটে গেল। “নাঃ, এখানে পিকনিক করলে তেমন মন্দ হবে না” নিজের মনেই বললাম।

ওই যাঃ, আমার সঙ্গী আবার কোথায় গেল? এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে হাঁফ ছেড়েছি, আর দেখ কান্ড! তাকে ডাকতেই যাচ্ছিলাম, এমন সময় ঠিক কানের কাছেই  আচমকা “চলেন” শুনে আঁতকে উঠেছি। অবাক হয়ে দেখি, অবিকল সেই রকম মুড়িশুড়ি দেওয়া, হ্যারিকেন হাতে লোকটা….কিন্তু হলফ করে বলতে পারি এতক্ষণ এর সঙ্গে আমি আসি নি! এও যে বয়স্ক কোনো লোক! চোখ কচলে তার দিকে আবার তাকিয়ে দেখলাম সেও যেন বেশ মজা পেয়ে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। আমতা আমতা করে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম:

– “সে কোথায় গেল ভাই?

– কে বাবু? 

– যার সাথে এতক্ষণ আসছিলাম? 

– আমার সঙ্গেই তো আলেন বাবু!

– কি বলছো? তুমি তো বুড়ো মানুষ। সে তো একটা রোগাপাতলা লোক ছিল!! 

– মু ছাড়া এবাইতে (বাড়ীতে) আর কেউ কাজের জন নাই বাবু। আসেন, মালিক অপেক্ষা করেন।”

আমাকে বিস্ময় প্রকাশ করবার আর এতটুকুও সুযোগ না দিয়ে সে আগের লোকটার মতই আলোটা হাতে ঝুলিয়ে হাঁটতে শুরু করে দিল। সত্যি বলতে আমার তখন রীতিমতো গা ছমছম করছিল, কোন বিপদ অবশ্যম্ভাবী মনে হলে যেমন হয়। একবার ভাবলামও, কাজ নেই আর এগিয়ে। রিকশাটা যখন এখনও অপেক্ষাই করছে, তখন ফিরেই যাই না কেন ভালোয় ভালোয়। কিন্তু কর্তব্য বড় দায়, আর তার থেকেও বড় অস্বস্তি লাগল নিজেকে কাপুরুষ ভাবতে। “কি এসব চিন্তা করছি এগুলো? মাথাটা কি খারাপ হয়ে গিয়েছে আচমকা? আঁধারে অন্ধকারে এরকম ভুল যেকোনো কারোরই হয়। কি দেখতে কি দেখেছি, ভাবছিও ভুলভাল। আসলে ফেরার চিন্তাটা আছে বলেই হয়ত” – নিজেকে স্বান্তনা দিতে দিতে আবার এগোলাম লোকটার পিছন পিছন।

এখন বাড়ীর মালিকের মুখোমুখি বসে আছি। এইমাত্র হল, আবার বেশ কিছুটা হাঁটিয়ে এবং হোঁচট খাইয়ে আমার লন্ঠনধারী পার্শ্বচর অবশেষে আমাকে ওনার ঘরে পৌঁছে দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হয়েছে। ঘরে ঢুকতে ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছি, বাকী বাড়ীটার তুলনায় এই ঘরটা অপূর্ব সব কারুকার্যমন্ডিত আসবাবপত্রে ভরা, এবং চারদিকের দেওয়াল ও ছাদের সাজসজ্জাও রীতিমতো যাকে বলে ‘রয়্যাল’ শ্রেনীর। মুগ্ধ চোখে দেখছিলাম সেই জমিদারী যুগের একটুকরো ঝলক। লোকটা চলে যেতে আমি মালিকের দিকে চাইলাম, এবং কিমাশ্চর্য্যম!! আবার সেই চমক। প্রথম দেখায় আমি নমস্কার করাতে ভদ্রলোককে মনে হয়েছিল আমাদেরই বয়সী হবেন। এখন মাথার উপরের মাঝারী আকারের, কিন্তু বাহারী ঝাড়লন্ঠনটার নরম আলোতে দেখে ওনাকে খুব কম করেও সত্তর বছর বয়স্ক অন্য কেউ লাগছে। যাই হোক, আজ এটা এতটাই বেশী বার ঘটেছে, যে অনুভব করলাম আমার মস্তিষ্কও আপাতত বেশ মানিয়ে নিয়েছে। যেন দিনরাত্রি বা সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের মত এটাও খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, তার বেশী কিছু নয়। একবার হাতের ঘড়িটার দিকে চোখ যেতে দেখলাম কাঁটাগুলো স্থির। যাক্, ভালদিনেই ব্যাটারীটাও গেল। তাড়াতাড়ি কথা সারতে হবে ভেবে কিছু বলার আগে ছোট্ট করে একবার গলা খাঁকড়ানি দিতেই দেখলাম বেশ হাসিহাসি মুখে ভদ্রলোক বলে উঠলেন:

– ” আপনি বনভোজনের জন্য ভাড়া নিতে চান?

– হ্যাঁ, শুনেছি আপনারা না কি ভাড়া দেন?

– কবে চান? 

– সেটা এখনও ঠিকঠাক হয় নি অবশ্য। আসলে আমার এক বন্ধু দেশের বাইরে থাকে। সে আসছে কদিন বাদেই। তারপর….

– অঅ। ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা নেই। পেয়ে যাবেন! 

– ভাড়া কেমন? অ্যাডভান্স..মানে অগ্রিম কত দিতে হয় টয় একটু..?

– হবে, ওসব হবে। আপনি আসছেন কোথা থেকে?

– আমি এমনিতে এখন ইসলামবাজারে থাকি। আদতে কলকাতার লোক।

– কাজ করেন ওখানে?

– ওখানকার জেলা হাসপাতালে আছি।

– আপনি ডাক্তার? 

– হ্যাঁ! 

– আরে, আপনি তো গণমান্য ব্যক্তি। ছি ছি, চিনতেই পারি নি। কিছু মনে করবেন না মশাই। 

– আপনি উতলা হবেন না। এতে তো মনে করবার মত কিছু নেই! 

– আপনি কোন রোগ দেখেন ডাক্তার? 

– আমি সাইকোলজিস্ট। মানে, মনের রোগের চিকিৎসা করি। 

– মাথার ব্যামো? মানে পাগল? সারে? 

– ঠিক তা নয়। মানে মনের অসুখ মানেই পাগল নাও হতে পারে..

– সারে কি??

– দেখুন, এভাবে তো বলা যায় না। অনেক পরীক্ষা করতে হয়, সাইকোথেরাপির বিভিন্ন ধাপ আছে। রোগীর সাথে কথা বলতে হয়। বাড়ীতে কারোর এরকম কিছু আছে কিনা সেই….”

কথাটা পুরোপুরি শেষ না করতে দিয়েই সে হঠাৎ করেই তার একহাত তুলে আমায় থামতে বলাতে চমকে গিয়েই থেমেছি। পরের একটানা পাঁচ ছয় মিনিট তার মুখে যা যা শুনলাম, তাতে দশবছরের উপর জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা করা, হাজার হাজার মানসিক রোগী দেখা ডাক্তারবাবুর সারা শরীরও আস্তে আস্তে হিম হয়ে এল। অদ্ভুত উত্তেজনায় ভরা তার দীর্ঘ বক্তব্য ছিল:

“দেখুন মশাই, বাড়ী ভাড়া বলুন, কি ডাক্তারী করা বলুন..মাথা ঠিক রাখতে পারলেই সব ঠিক। নইলে সবই বরবাদ। আমায় একবার দেখুন, অনেকে সন্দেহ করে আমার না কি মাথার ব্যামো আছে। জানি না কতটা সত্যি, কিন্তু টানা দেড়শো-দুশো বছর ধরে একই কথা সবার কাছে শুনলে কেমন অদ্ভুত লাগে না, বলুন? আজ আপনাকে পেয়েছি, এ আমার পরম সৌভাগ্য। অনেকদিন ধরে মনে হচ্ছিল নিজেকে একটু পরীক্ষা টরীক্ষা করিয়ে দেখলে কেমন হয়? কিন্তু সমস্যা হল যে, আমি আবার দিনের আলো টালো তেমন সহ্য করতে পারি না, তাই ঐ সময়টা অন্দরমহলেই কাটাই বেশীরভাগ। অভ্যাস হয়ে গেছে, অনেক যুগের ব্যাপার তো! এই ছোটখাট কাজকর্ম, লেখালেখি, লোকজনের সাথে কথাবার্তা সব রাতের দিকেই করি। তবে বিশেষ আসেটাসে না কেউ এখন আর। অনেকদিন বাদে যেমন আপনি এলেন আজ!!” অনেকক্ষণ বকে লোকটা পরপর দুবার বিরাট হাই তুলে থামল!

আমি ততক্ষণে নিজের আশুকর্তব্য স্থির করে ফেলেছি। চুলোয় যাক বন্ধুত্ব, বরবাদ হোক সুব্রত আর তার পরিবারের গ্রামবাংলা ভ্রমণের উটকো শখ! আমাকে তাড়াতাড়ি পালাতে হবে, এই বিপজ্জনক উন্মাদের কবল থেকে..যে করেই হোক..এখনই, এই মুহূর্তে! কিন্তু কি করে পালাব?? ও যে সটান বসে আছে দরজাটার ঠিক পাশেই! 

লোকটা বোধহয় মানুষের মন পড়তে পারে। এসব ভাবতে গিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। সামলে নিয়ে এক সেকেন্ডের জন্য চোখাচোখি হতে আগের মতই মোলায়েম গলায় লোকটা বলল:

– ” ও ডাক্তারবাবু! আপনি মিছেই ডরান। আপনার এক পয়সাও ভাড়া দিতে লাগবে না। যত খুশি পিকনিক না কি বনভোজন ওসব করেন!

– না, মানে..অন্য আরেকদিন আসব বুঝলেন! আজ উঠছি, কেমন? অনেকদূর ফিরতে হবে তো।

– যাবেন তো! আপনাকে আমার গরীবখানায় বরাবরের জন্য আটকে রাখতে থোড়াই পারব? তবে চিন্তা করেন না। রিকশাওয়ালাটা আছে এখনও, ঘন্টাখানেক হতে ঢের বাকী!! 

– আ..আ..আপনি ক্কি কি করে জানলেন এসব..?? কেউ তো ছি..চ্ছিলো না?

– এটাই তো কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারি না ডাক্তার। সবাই ভাবে আমি একটা বদ্ধ পাগল। তুমি কি জান, আমার এই এত বড় বাড়ীর আশপাশের, বহুদূরের, সঅঅবকিছুর শব্দ আমার কানে বাজে সর্বক্ষণ!! সর্বক্ষণ! এখনও বাজছে! আমার দিন নাই, রাত নাই..যুগ যুগ ধরে ঘুম নাই..কিসের এ অভিশাপে কত বছর আমার চোখের পলক পড়ে নাই..আমায় বাঁচাও ডাক্তার! এ বাড়ী আমি তোমাকে দান করে দেবো..সব দিয়ে দেবো..বিশ্বাস কর..টাকা, গয়না, জমিজমা..সঅঅব, সব! শুধু আমায় একটু ঘুম পাড়িয়ে দাও ডাক্তার..দয়া কর..আঃ আঃ, নাআআআ, আর পারছি নাআআ!!!!”

বলতে বলতে হঠাৎ দেখলাম লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এগোতে এগোতে নিজেরই ঘাড়ের নীচে দুইহাত দিয়ে উন্মত্তের মত টানাটানি শুরু করেছে, যেন মুন্ডুটা উপড়েই ফেলতে চায়। এতক্ষণে আমার দৃষ্টিগোচর হলো তার হাতের বড়বড়, ভয়ঙ্কর নখগুলো..যেন দুঃস্বপ্নে দেখা কোনো ভয়াল পিশাচের হিংস্র, ধারালো নখর!!

আতঙ্কে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সন্মুখের ভয়াবহ দৃশ্যের চিত্রনাট্য যেন আমার কাছে নিঃসীম এক অভিশপ্ত রাতের অদৃষ্টপূর্ব পটভূমিকা উন্মোচিত করল। চোখের সামনে দেখলাম লোকটার ধারালো নখগুলো তার ঘাড়ের নীচের মাংসে বসে যাচ্ছে..তারপর ফিনকি দিয়ে রক্তের ধারা ছুটলো..তার মুন্ডুটা উপড়ে ছিটকে গেল একদিকে..দেখলাম ধীরে ধীরে তার বাকী শরীরের যাবতীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো এক এক করে খসে ঝরে ঝরে পড়ছে ঘরের মেঝেতে..একের পর এক..রক্তমাখা হাত, পা, উদর, মাংসপেশী, পঞ্জরাস্থি….সহসা বিষম পূতিগন্ধে ভরে গেল গোটা ঘর..উপর থেকে সশব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ল জ্বলন্ত ঝাড়লন্ঠনটা..একপলকে আগুন ধরে গেল লোকটার কবন্ধ দেহাবশেষে..মাংসপোড়া বীভৎস গন্ধে আমার নাড়ী উল্টে আসতে লাগল..মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম আমি একটা প্রায় ভেঙে পড়া, বয়সের ভারে জীর্ণ, বহুপুরাতন ঘরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি…

ভয়ের শেষ সীমানায় পৌঁছলে শুনেছিলাম মানুষ না কি বাঁচার অন্তিম প্রচেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে..একটা আর্ত চিৎকার করে আমি সেই জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডটার পাশ কাটিয়ে লাফিয়ে বেরোলাম অভিশপ্ত ঘরটা থেকে। সঙ্গে আনা ব্যাগ, টর্চ সব পড়ে রইল সেখানে। অন্ধকারের মধ্যে ধাক্কা খেতে খেতে একটু আগে আসা পথের যেটুকু মনে ছিল, তাতেই পড়িমড়ি ছুটতে থাকলাম..যে করেই হোক, এই ভয়াবহ প্রেতপুরীর থেকে বেরোতেই হবে আমাকে…

নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিল..তাও ছুটছিলাম প্রাণপনে.. অবশেষে চাঁদের হালকা আলোয় দেখতে পেলাম সেই ঝোপঝাড়ের জঙ্গল আর..সেটা পেরিয়েই সেই আধভাঙা সিংহদরজাটা..ঐ তো দেখা যাচ্ছে! হৃৎপিন্ড যেন এক্ষুনি থেমে যাবে এমন বোধ হচ্ছিলো..আর যেন ছুটতে পারছিলাম না..একটু, আর একটু..তারপরই জীবন..জ্যান্ত মানুষের পার্থিব জগৎ..একটুখানি জল পেলে বেঁচে যাই..দাঁড়াও..একটু, আর একটুখানি..!!

অবশেষে সেই সিংহদরজার বাইরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে রাস্তার ধুলোর উপরেই যে কখন হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছি তা আর খেয়াল নেই। ঘামে ধুলোয় মাখামাখি গোটা শরীর! বেশ কিছুক্ষণ বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে তারপর আস্তে আস্তে উঠে বসলাম। মনে এল এবার ফিরতে হবে, এই অভিশপ্ত জায়গাটায় আর একমুহূর্ত নয়। নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম প্রায় নিশ্চিত আতঙ্কের হাত থেকে বাঁচিয়ে পুনর্জন্ম ঘটাবার জন্য! ইতিউতি তাকিয়ে দেখি সেই ঢিমে ওয়াটের অস্পষ্ট বাল্বের আলোর নীচে মাফলার মুখে জড়িয়ে গাড়ীর উপর আমার রিকশাওয়ালাটা ঝিমোচ্ছে। আমি গিয়ে ডাকতে তন্দ্রা ভেঙে উঠে সে কিছুক্ষণ যেন আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চিনতেই পারল না। তারপর তার দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে হাই তুলে বলল:

– “বাবু, আপনে অনেক দেরী করে ফ্যাললেন আজ়। টেরেন বেইরে গেসে। আপনার আর গে কাজ় নাই!

গলার সুরটা যেন কিরকম! ভুরু কুঁচকে আমি কিছু বলবার আগেই দেখি সে তার লম্বা আঙুলটা তুলে আমার পিছনপানে ইশারা করছে। প্রথমে ঠিক বুঝি নি। পরে পিছনে ফিরতেই আচম্বিতে শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত বয়ে গেল…দেখলাম সেই ভয়াবহ বৃদ্ধ লোকটার কাটামুন্ডুটা..চোখদুটো যেন জ্বলছে..আমার ঠিক মুখের সামনেই হাওয়ায় সেটা যেন ভাসছে..স্পষ্ট শুনলাম গম্ভীর গলায় সে বলল, “আমায় একটু ঘুম পাড়িয়ে দাও না ডাক্তার..তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি..!!”

আর কিছু মনে নেই……!!!!!!!!

…….শীতকালের কোনও এক সন্ধ্যেয়, নদীর ধারের বিরাট জমিদারবাড়ীটার সামনে আমার রিকশা থেকে নামল এক সুবেশ ভদ্রলোক। ভাড়া নেওয়ার সময় দেখলাম সে যেন বেশ একটু অবাক হয়েই তাকালো আমার মুখের দিকে। ভাড়া মেটাবার পর জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা দাদা, এখান থেকে ফেরার সময় রিস্কা, ভ্যান ট্যান এসব পাবো তো? মানে অনেকদূর ফিরবো তো ট্রেন ধরে, তাই!” আমিও চোস্ত জবাব দিলাম, “না বাবু, এদ্দূরে কেউ সাঁঝের পর আর আসতে চায় নে। তবে আপনে বইললে মু ঘন্টাখানিক থাকব আজ্ঞে। আপনারে ইস্টিশনে নে ছাড়ে দিব!!” লোকটা দেখলাম আমার কথায় বেশ খুশি হয়ে মাথা নেড়ে একটা সিগারেট ধরাল, তারপর শিস দিতে দিতে জমিদারবাড়ীর ভাঙা সিংহদরজাটার একদিকের পাল্লাটা সরিয়ে ভিতরে ঢুকল। আমি গলার মাফলারটা ভালো করে মাথা দিয়ে জড়িয়ে চোখদুটো বুজে যথারীতি ঢুলতে শুরু করলাম! 

হাতে অনেকটাই সময় আছে, লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে ফেরা অবধি বেশ একচোট ঘুমিয়ে নিতে পারব এখন…!!! 💀☠️👽

ওটা কে ছিলো_Srilekha Kundu

 ওটা কে ছিলো?

শ্রীলেখা কুন্ডু 

ছাদের ফুরফুরে শীতল হাওয়ার মনটা বেশ সতেজ হয়ে গেলো আরোক্ষীর, আজকের খাওয়াটা বেশ চেপে হয়েছে, মনে হচ্ছে আজ অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে হবে। খাওয়া-দাওয়ার পর হাঁটাহাটি করার অভ্যাস আরোক্ষীর আজকের নয়, সেই কিশোরী বয়স থেকে। বাবা শিখিয়েছিলেন, এতে নাকি খাবার তাড়াতাড়ি হজম হয়। সত্যি কি মিথ্যা জানে না, কিন্তু খাওয়া-দাওয়ার পর প্রত্যেকদিনই এটা করে থাকে আরোক্ষী, আজ মামাবাড়িতে এসেও ব্যাতিক্রম হয়নি। হ্যাঁ আজ সকালেই এসেছে মামাবাড়ি বাবা আর মায়ের সাথে, মা আর আরোক্ষী কটাদিন মামাবাড়িতে কাটাবে, বাবা আজ বিকেলেই চলে গেছেন হঠাৎ একটা কাজ পড়ে যাওয়ায়, না হলে রাতটা থেকে যাবার কথা ছিলো। আজ অনেক বছর পর মামার বাড়িতে থাকা হবে আরোক্ষীর, প্রায় পাঁচ বছর পর তো হবেই। অন্য সময় মাঝে-সাঝে মামাবাড়ি এলেও থাকা হয়নি, এখন উঁচু ক্লাসের পড়াশোনা, চাপও প্রচুর তাই বেশ কয়েক বছর ইচ্ছে উপায় ছিলো না। এখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর একটু শান্তি। যাইহোক, অনেক দিন পর ভালোভাবে ওদের পেয়ে মামাবাড়ির সবাই খুশি, আরোক্ষীও খুশি। আজ সবাই মিলে বেশ মজা হলো, মামি তো জম্পেস রান্না করেছিলেন, খাসির মাংস, দই ইলিশ, পোলাও, সব মিলিয়ে খাওয়াটা বেশ ভারী হয়ে গেছে।

শীতল হাওয়ায় মোবাইলে গান শুনতে শুনতে বেশ হাটছে আরোক্ষী, হঠাৎ চোখে পড়ল সিড়ির দরজার দিকে, সিঁড়ির দিকটা মিশমিশে অন্ধকার, ছাদেও অবশ্য অন্ধকার তবে তুলনামূলক কম, আজকাল গ্রামের রাস্তায়ও একটু আধটু আলো আছে, আগের মতো একদম মিশ মিশে অন্ধকারটা আর নেই। সেই টিমটিমে আলোয়, ছাদে একটু হলেও অন্ধকার ফিকে হয়েছে, আর সেই আলোতেই আরোক্ষীর মনে হলো, দরজাটা হালকা নড়ে উঠলো না? হ্যাঁ নড়েই তো উঠলো, এমনকি খুট করে হালকা আওয়াজও হলো একটা, দরজার পিছনে কি কেউ আছে? নাকি পুরোটাই মনের ভুল আরোক্ষীর? এতো জোরেও হাওয়া দিচ্ছে না যে দরজাটা ওইভাবে নড়ে উঠবে!! কেউ কি উঠে এসেছে? নাহ্, তাহলে তো সে ছাদে উঠে আসবে, মামাবাড়ির কেউ খামোখা ওখানে কেন দাঁড়াতে যাবে? আর এখন এতো রাতে বাইরের কেউ ও আসবে না। দুর হবে কিছু একটা, এই ভেবে ঠোঁট উল্টে তাচ্ছিল্য করে গান শোনায় মন দিলো আরোক্ষী। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আচমকা আবার সেদিকে চোখ পড়তেই বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। এবার যেন স্পষ্ট মনে হলো কেউ দরজার ওদিক থেকে আরোক্ষীকে লক্ষ্য করছে !! এখানে ওকে আড়াল থেকে লক্ষ্য করার মতো কে থাকবে? ব্যাপারটা কি হচ্ছে দেখবার জন্য আরোক্ষী মোবাইলের আলো জ্বেলে এগিয়ে গেলো, সিড়ির উপর থেকে নীচে অবধি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাউকেই দেখতে পেলো না আরোক্ষী, দুবারই মনের ভুল, হতে পারে কি? হতে পারে না কেন? হচ্ছেই তো; নিজেকে নিজেই বোঝায় আরোক্ষী। এবার ছাদের দিকে ফিরে সোজাসুজি তাকিয়েই থ হয়ে যায় আরোক্ষী, ছাদের ওইদিকের পাঁচিলের উপর ওটা কে বসে আছে? এবারেও কি চোখের ভুল? কিন্তু তা কি করে হবে অন্য গুলোতে না হয় দেখা যায়নি কিছু, এটা তো বেশ পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, কালো রঙের কোনো কিছুর ছায়া, আবার একটু দুলছে না? হ্যাঁ তাই তো… এটা কি কোনো বিড়াল? না তো, বিড়াল কি এতো বড়ো হবে? তাহলে? ভাবতে ভাবতে আগাগোড়া সাহসী আরোক্ষীরও কেমন যেন একটা অনুভূতি হতে লাগলো, মোবাইলের আলো জ্বালিয়েও যে দেখবে সে সাহসেও কুলোচ্ছে না, কিন্তু কিসের যেন অমোঘ আকর্ষণে সেখান থেকে ছুটেও পালিয়ে যেতে পারছে না, বরং সেই বস্তুটির দিকেই এগোতে লাগলো, যেতে যেতে পায়ে কিসের হোঁচট লাগতেই তাড়াতাড়ি আলো জ্বালিয়ে দেখে একটা টব !! আর কালো মতো বস্তুটা আর কিছুই না, ওই টবেরই গাছ !! এবার আর না থাকতে পেরে হায় হায় করে কপাল চাপরাতে লাগলো আরোক্ষী, সত্যি এতো বছর পর মামাবাড়িতে রাত কাটানোর চাপ যে এরম হবে ভাবতেই পারেনি আরোক্ষী, এই নিয়ে তিনবার বোকা বনে গেলো সে, নাতো তিনবার নয় চারবার, ছাদে ওঠার জন্য যখন অন্ধকারে সিড়ির দরজা খুলতে গেছে, তখনই অনুভব করে ঘাড়ে যেন কার নিঃশ্বাস, শুধু তাই নয়; নিঃশ্বাস ফেলবার শব্দটাও যেন শুনেছিলো, সেটা অবশ্য অস্পষ্ট ছিলো। তখনো সাথে সাথেই পিছনে ফেরে আরোক্ষী, কিন্তু ওই কাউকে দেখা তো দূর, কারো অস্তিত্বই টের পায়নি, শুধু চাপ চাপ অন্ধকার ছাড়া।

ধুত্তেরি, নিকুচি করেছে হাঁটাহাঁটির, বিরক্ত হয়ে যেই ছাদ থেকে নীচে যাবার উদ্দেশ্যে পিছনে ঘুরতে যাবে আরোক্ষী, ওমনি “হাউ” শব্দ, সেই সাথে আচমকা পিঠে জোর ধাক্কা !! “বাবা গো”, বলে চিৎকার করে ওঠে আরোক্ষী, ধাক্কার চোটে পড়েও যাচ্ছিল, নেহাত টাল সামলে নিলো তাই। তখনই পিছন দিক থেকে একটা খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসে। তখনই পিছনে তাকিয়ে দেখে, কান্ডখানা আর কারো নয়, ওর মামাতো বোন পিয়ুলীর। আরোক্ষী তো ওকে দেখে রেগেই আগুন।

পিয়ু তুই, দাঁড়া তোকে আমি…. বলে বোনকে মারতে যেতেই ও খিলখিল করে হাসতে হাসতে দৌড় দিলো, ওর পেছন পেছন আরোক্ষী, কিন্তু ও যে ওকে ধরতেই পারছে না, যখনই ধরতে যাচ্ছে পিয়ুলী যেন ছিটকে চলে যাচ্ছে, এ কি তার বোন পিয়ুলী? যে একবার দৌড়েই ধরা পড়ে যায় !! আর তাছাড়া আরেকটা জিনিস, ও যখনই পিয়ুলীকে ধরতে যাবে, পিয়ুও যেন কিভাবে সরে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে, ঠিক যেন হাওয়ায় ভেসে !! আরোক্ষী যা দেখছে সব ঠিক তো? এক সময়ে আরোক্ষী আর না পেরে থেমে গেলো, হাঁপিয়ে উঠেছে ও, দিদির দশা দেখে পিয়ুলী তো হেসেই খুন, তারপর যখন বুঝতে পারলো দিদি রাগ করেছে দিদির কাছে এসে সোজা নিজের কান দুটো ধরে বলে, “সরি দিভাই ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না প্লিজ, প্লিইইজ।” বোনকে এরম করতে দেখে আরোক্ষীও রাগ ভুলে হেসে উঠলো, “আচমকা এসে এরম করলি, ভয় লাগে না বলতো?” পিয়ুলী তখনো দুই কানে দুই হাত ধরে দাঁড়িয়ে, “বলছি তো ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না।” আরোক্ষীর খুব ভালো লাগলো এরম খলবল করে কথা বলতে থাকা বোনকে দেখে, এতোদিন শুধু ওর শান্ত স্বভাবটাই দেখেছে আরোক্ষী, এই জন্য কম রাগায়নি বোনকে, সকাল বেলা ওরা মামাবাড়িতে আসার পর বোনের সাথে এখনো পর্যন্ত ভালো করে কথা হয়নি আরোক্ষীর, এবার তাহলে বেশ গল্প করা যাবে…

“আচ্ছা আচ্ছা ঠিকাছে, আর কান ধরতে হবে না, আয় গল্প করি” বলে আরোক্ষী নিজেই বোনের কান থেকে হাত দুটো ধরে নামাতে গিয়েই আবার চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিলো?

“কি হলো রে দিভাই? চমকে উঠলি যে?” তারপর মুখে হাসি বুলিয়ে বললো, “আবার ভয় পেলি নাকি?”

“না মানে, তোর হাত দুটো এরম বরফের মতো ঠান্ডা কেন রে পিয়ু?”

“হাত দুটো !! ওওও, আসলে আমার খুব গরম লাগছিল তো তাই স্নান করে এসছি, কিন্তু চুল ভেজাইনি, হি হি হি।”

“স্নান, এই রাত্তিরে? তার উপর আবার তুই?”

“হ্যাঁ, কেন?”

“কেন মানে? একে তো ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব, তার উপর রাতের বেলা, অথচ তোর নাকি এতো গরম লাগছে তুই স্নান করে এলি, আর তাছাড়া তুই আগাগোড়া শীত কাতুরে বলে জানি, আর এখন বলছিস…!!!!”

“আর স্নান করলে কি কারো শরীর এরম বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যায়?” শেষের কথাগুলো আরোক্ষী নিজের মনেই বললো।

“কিরে দিভাই কি বিড়বিড় করছিস?”

“না কিছু না, তবে তুই কথায় কথায় এরম হাসিস না তো ভূতের মতো !!”

হাসি থামিয়ে পিয়ুলী বলে, “ভূতের মতো? আচ্ছা বাবা ঘাট হয়েছে, আর হাসবো না।”

তারপর আরোক্ষী আর পিয়ুলী গল্প করতে লাগলো। আরোক্ষী খেয়াল করলো, পিয়ুলীই যেন একটু বেশিই কথা বলছে, আরোক্ষী কথা কম বলবারই সুযোগ পাচ্ছে, যেটা সচরাচর হয় না। বরং অন্য সময় আরোক্ষী কথা বলতে থাকে, পিয়ু মন দিনে শোনে, হয়তো দু-চার কথার উত্তর দেয়।

খানিকক্ষণ পরে পিয়ুলী বলে ওঠে, “এই দিভাই, অনেক রাত হয়েছে রে, চল এবার নীচে যাই। আচ্ছা আগে আমি যাই, তারপর তুই আয়।” বলে আরোক্ষীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঝড়ের গতিতে অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো।

আরোক্ষী হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে বোনের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বোন চলে যাবার পর আরোক্ষীর মনে হলো চারিদিকে কেমন যেন একটা নিকষ কালো অন্ধকার আর নিরবতা গ্রাস করে আছে। আরোক্ষীর গাটা কি শিরশির করে উঠল? আর অপেক্ষা না করে ছাদ থেকে নেমে এলো সে।

ঘরে এসে দেখে, মা আর মামিমা তখনো বসে গল্প করছে বসার ঘরে। অনেকদিন পর তো দুজন গল্প করার এতো সময় পেয়েছে, তাই কথা আর ফুরুচ্ছে না।

আরোক্ষীকে দেখে মামিমা হাসলেন, মা জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় ছিলি মামন?”

“এইতো ছাদে ছিলাম।”

“ছাদে, এতো রাতে। তুই এতো রাতে ছাদে ছিলি? কেন? আমি ভাবলাম তুই বোধহয় দিদার ঘরে !!” মামিমা তো প্রায় আঁতকে উঠেছেন।

“হ্যাঁ, খাবার পর একটু হাঁটাহাঁটি করছিলাম !! কেন মামি?”

“না না মামন, রাতের বেলা আর ছাদে উঠবি না এরম, একা একা তো নই।”

“কেন গো বউদি, রাতের বেলা ছাদে উঠলে কিসের অসুবিধা, আর মামন তো এমনি সাহসী, তাই…”

মায়ের কথা শেষ না করতে মামি বলে উঠলেন, কিছুটা গম্ভীর ভাবেই, “দেখো ঠাকুরজি, তোমরা শহরের মানুষ তোমাদের কাছে এগুলো হয়তো হাসির বিষয় মনে হবে, কিন্তু আমদের মানে গ্রামের মানুষদের এসব মানতেই হয়, সন্ধ্যের দিকে একা বেরোনো, বা ছাদে ওঠা উচিৎ নয়, কতোকি আমাদের চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়, যেগুলো দেখা যায় না, কিন্তু…”

“কিন্তু কি বৌদি? আর তাছাড়া ছোটো থেকে আমিও তো বড়ো হয়েছি এখানে, সেরকম তো কিছু….” মায়ের মুখ থমথমে।

মামিমা হয়তো বুঝতে পারলেন এতোটা গম্ভীর হওয়া উচিৎ হয়নি। তাই নিজেকে তৎক্ষনাত সামলে নিয়ে হাসি মুখে বললেন, “আরে না তেমন কিছু না, আমিও না, কখন কি বলতে কি বলে ফেলি, বলি আজ রাতে কি ঘুমাতে হবে না? কটা বাজে সে খেয়াল আছে? কাল সকালে উঠতে হবে। চলো ঠাকুরঝি শুয়ে পড়া যাক।”

মামিমার কথায় মাও এবার হেসে ফেললেন, তবে হাসিটা যে জোর করে সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারলো আরোক্ষী। মা মামিমাকে বললেন, “হ্যাঁ বৌদি চলো শুয়ে পড়া যাক, অনেক রাত হলো, যা মামন তুইও শুয়ে পড়।”

-হ্যাঁ মামন যা বোনের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়, ও ঘরে একা আছে। তোর জন্যই আজকে ও নিজের ঘরে শুয়েছে, নাহলে যা ভীতু, এতো বড়ো হলো এখানো তোর দিদার সাথেই শোয়, আজ তোরা দুইবোনে একসাথে ঘুমা, অনেকদিন পর।

মা বললেন, “ও আরেকটু বড়ো হোক ঠিক হয়ে যাবে, ভেবো না বৌদি। এই তো…..

মা আর মামিমা কথা বলতে বলতে নিজেদের ঘরে চলে গেলেন, কিন্তু আরোক্ষীর মনে জোর খটকা, মামিমা কি বলে গেলেন? বোন ভীতু, একা শুতে ভয় পায় !!!

নাহ্ আর দাড়িয়ে থেকে লাভ নেই, অনেক রাত হলো, এবার শোয়া যাক। এই ভেবে আরোক্ষী বোনের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ঢুকে দেখে পিয়ুলী একটা বই পড়ছে, হাসির বই, এতো মনোযোগ দিয়ে পড়ছে যে দিদি আরোক্ষী ঘরে ঢুকেছে ও টেরই পায়নি। এদিকে আরোক্ষী ভাবছে, বোনটা কি বেরসিক(হাসির গল্পের বই পড়ে বেরসিক?) !! এই রাতেরবেলা কোথায় একটা টানটান ভয় মেশানো ভূতের বই পড়বে, তা না ও বাচ্ছাদের মতো হাসির বই…!! তবে ভূতের কথা মনে আসাতে আরোক্ষীর মাথায় ও একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেললো, সে আচমকা লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে সোজা বোনের পাশে। এদিকে পিয়ুলী তো ভীষণ চমকে গেছে, সে ভয়ে চেচিয়েই ফেলেছে, সেই সাথে একপাশে গুটিশুটি মেরে বসে দেখে দিদি, তবে ও যে খুব ভয় পেয়েছে সেটা ওর মুখ দেখলেই বোঝা যায়। এদিকে আরোক্ষী তো ওর অবস্থা দেখে হেসেই খুন, “কিরে কেমন দিলাম হ্যাঁ, তুই কি ভেবেছিস তুই একাই পারিস, আর কেউ পারে না?”

“দিভাই দেখ, এরকম ইয়ার্কি কিন্তু ভালো লাগে না, জানিস তো আমি ভয় পাই। এখনো আমার বুক ধরফর করছে” বলে পিয়ুলী নিজের বুকে হাত রাখে।

“ও, তাই নাকি, তুমি আবার ভয়ও পাও !! তা নিজের হলেই বুঝি শুধু ভয়টা আসে, আর ছাদে গিয়ে অন্যকে ভয় দেখাতে গিয়ে বুজি খুব সাহস বেড়ে যায়?”

মানে? কে ছাদে গেছে? ছাদে তো তুই গেছিলি, আর ভয়ই বা কে কাকে দেখিয়েছে?”

“বাবা রে, তোর তো দেখছি ভালোই উন্নতি হয়েছে বোনু !! সন্ধ্যাবেলায় দিব্বি ছাদে উঠে আমাকে আচমকা ভয় দেখিয়ে চলে এলি। আবার এখন ভয় পাবার অভিনয়, দারুণ দারুণ।”

“মানে? কি বলছিস দিদি? আমি কখন ছাদে গেলাম? এমনিতেই সিড়ি দিয়ে একা ছাদে উঠতে ভয় পাই, তার উপর আবার তুই বলছিস আমি ভয় দেখিয়েছি !!!”

“তুই কি বলছিস, ওটা তুই ছিলি না, শুধু ছাদে কেন, ছাদের দরজার ওইপার থেকেও তো….”

আরোক্ষীর কথা শেষ না করতে দিয়েই পিয়ুলী বলতে থাকে, “দিভাই, বিশ্বাস কর, তোকে ছুঁয়ে বলছি। আমি তো সন্ধ্যার পর একা ছাদে যেতেই ভয় পাই, আর মাও না বলে। তাও আজকে তুই ছিলি বলে মা যেতে বলছিল, যাতে তোকে ছাদে বেশিক্ষণ থাকতে না করি। কিন্তু বিশ্বাস কর, যাওয়া তো দূর, একা অন্ধকার সিড়িতে উঠতেই ভয় করছিল, তাই যাইনি। ওটা আমি ছিলাম না বিশ্বাস কর।”

“আর তুই কি আজ রাতে স্নান করেছিস?”

“স্নান? এতো রাতে !! তুই কি পাগল হলি দিভাই? বাইরে ঠান্ডা হাওয়া আর আমি করবো এখন স্নান, এই রাতে? আমি তো কাঠ-ফাটা গরমেও এতো রাতে স্নান করি না, বা করলেও খুব কম।”

আরোক্ষী আর কিছু বলতে পারলো না, বোনের কথা শুনে আর কান্না দেখে ওর মনে হলো বোন ঠিকই বলছে। অস্ফুট স্বরে আরোক্ষীর মুখ থেকে একটাই কথা বেরিয়ে এলো, “তাহলে ও কে ছিলো?”

ততক্ষণে আওয়াজ শুনে ও ঘর থেকে মা আর মামিমা এসে গেছেন, “কি হচ্ছে রে হ্যাঁ? এতো রাত হয়ে গেলো তোদের আর কথা শেষ হচ্ছে না !! একি পিয়ু তোর মুখটা ওরম কেন? কি হয়েছে? আর মামন তুই বা অমন মুখ করে বসে কেন? নিশ্চয়ই দুইবোনে ঝগড়া করছিলি?”

কাদো কাদো মুখে পিয়ুলী বললো, “দেখোনা পিসি দিদি কি সব বলছে?”

“কি বলছে?”

“আচ্ছা তোমরাই বলো, আজ কি দিভাই ছাদে ওঠার পর আমি ছাদে গেছিলাম?”

“না তো !!”

“তাহলে দিভাই যে বলছে…”

“কি বলছে? এই, খুলে বল তো তোরা, কি হয়েছে…”

তখন আরোক্ষী আর পিয়ুলী সব ঘটনা ওনাদের দুজনকে খুলে বলে।

আরোক্ষীর মা অবাক হয়ে নিজের বৌদির দিকে তাকাতে দেখেন, তাঁর মুখ সাদা কাগজের মতো ফ্যাকাশে !! কিছুক্ষন পর বলে ওঠেন, “দেখলে ঠাকুরঝি এই জন্যই তখন আমি বলছিলাম।”

“কিন্তু বৌদি….?”

ততক্ষণে আরোক্ষীর দিদা আর মামা এসে গেছেন, ওনারাও সব শুনলেন। যাইহোক, ওরা দুবোন ভয় পেয়ে গেছে দেখে মামা একথা সেকথা বলে কথার মোর অন্য দিকে নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ সবাই একসাথে কাটানোর পর যে যার গরে চলে গেল, কিন্তু দিদা ওদের কাছেই সেই রাতে শোবার জন্য রয়ে গেলেন, ছেলেমানুষ, ভয় পেয়েছে, আবার কখন কি হয়।

দুই ননদ বৌদি নিজেদের ঘরে এসে শোবার পর আরোক্ষীর মা কে পিয়ুলীর মা বললেন, “হ্যাঁ তখন কি যেন বলতে বলতে মা এসে পড়ায় থেমে গেলে ঠাকুরজি?”

“আমরাও তো এখানে বড়ো হয়েছি, কোনো দিন তো কিছু….”

“দেখো বউদি, কখন কি হয় বলা হয় না, তাছাড়া তোমাদের একটা কথা বলা হয়নি।”

“কি বলতো বৌদি, কোনো গুরুতর কিছু?”

“ধরে নাও তাই, আমাদের পাড়ার রুননু গো?”

“হ্যাঁ রুননু, ওর তো আমাদের পাড়ার দুটো পাড়া পরেই বিয়ে হয়, একটা মেয়েও আছে, কি যেন নাম ছিলো ওর?

“মেঘালী।”

“হ্যাঁ, মেঘালী। আমাদের পিয়ুর বয়সী বোধহয়, ওরই সাথে খুব ভাব ছিলো, কিন্তু মামনকেও খুব ভালোবাসতো।”

হ্যাঁ, আমাদের বাড়ির সবার সাথেই ওদের ভালো সম্পর্ক, ওর মার সাথে আসতে আসতে এই বাড়ির ন্যাওটা হয়ে গেছিল, আর কাছাকাছি মামাবাড়ি বলে মাঝেমাঝেই আসতো এখানে।”

“আসতো মানে? এখন কি আর আসে না? হ্যাঁ ওর কথা জিজ্ঞেস করবো করবো করে আর করা হয়নি, আমরা এলেই তো ও খবর পেয়ে চলে আসে, এবার দেখছি এখনো আসেনি।”

“আর আসবেও না।”

“আসবে না? কি বলছো বৌদি, কেন আসবে না কেন?”

মাথা ঠান্ডা রেখে শোনো ঠাকুরঝি, মন শক্ত করো। আসবে না কারণ ও আর নেই, তিনদিন আগে কি ভাবে যেন জলে ডুবে মারা যায়।”

“কি বলছো বৌদি?” আরোক্ষীর মা প্রায় চিৎকার কলে ওঠেন। “ওতো আমাকে মাসি মাসি করতো। সেবার মামনের একটা লিপস্টিক দেখে ওর খুব পছন্দ হয়, তাই মামন ওকে দিয়ে দেয়, আর তাতেই কি আনন্দ। আমরা যখন আসতাম, এখানে এলে ওতো আমার মামনের সাথেই বেশি ঘুরতো !!”

“শান্ত হও ঠাকুরঝি, আর একটু আস্তে বলো, মেয়েদুটো এমনিই ভয় পেয়েছে, তার উপর এসব শুনলে…”

আরোক্ষীর মা এবার একটু গলা নীচু করে বললেন, “কেমন কদে হলো গো বৌদি? আমরা এলে ও একদিন না একদিন ঠিক দেখা করে যেতো, কেমন সুন্দর কথা বলতো, একন সেই মেয়েকে আর দেখতে পাবো না !!””

“কেমন করে হলো সেটা আর কি ভাবে বলি ঠাকুরঝি, সাতার জানতো না, তাও পুকুরে গিয়ে স্নান করতো, কারো কথা শুনতো না। পাড়ে বসে মগে জল ভরে ঢালতো, ওতেই ওর আনন্দ ছিলো, অনেকে বলে পা কোনো ভাবে পিছলে গিয়েই নাকি….”

“তবে ঠাকুরঝি, আমি ভাবছি অন্য কথা।”

“কি গো বৌদি?”

“আমাদের কাছে এলেই ও তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করতো, মামনের কথা বিশেষ করে, ‘মামন দিদি কবে আসবে?’ একদিন শুনেছিলাম আমার মেয়েকে বলছে, ‘তোর খুব মজা, তোর অমন একটা দিদি আছে, তোকে কতো ভালোবাসে কতো কি দেয়, আমারো যদি থাকতো।’ এইতো, মারা যাবার কদিন আগেও খোঁজ করছিল ‘মামন দিদি কবে আসবে, আসলে বলো কিন্তু’ আর আজ মামনের সাথে এরম হলো।”

আরোক্ষীর মা এসব শুনে নড়েচড়ে বসলেন, “কি বলছো বৌদি, মামনের সাথে আজ যা হলো, তার সাথে কি মেঘালীর মারা যাবার জন্যই, মানে মেঘালী মৃত্যুব পর… না না, এরমও হয়?”

“দেখো ঠাকুরঝি, আগেও বলেছি, কখন যে কি থেকে কি হয় কেউ বলতে পারে না। আপাতত আজকের রাতটা ঠাকুরের নাম করো, কাল মাকে বলে মামন আর পিয়ু দুজনকেই মায়ের মন্দিরে নিয়ে যাবো, আর আমাদের বাড়িতেও কোনো পূজার ব্যবস্থা কথা যায় নাকি দেখবো। আপাতত যে কটাদিন তোমরা থাকবে মামনকে চোখে চোখে রাখতে হবে। আপাতত ঘুমাও।”

“হ্যাঁ সেই ভালো।”

এই ঘটনার পরেই মামন ওরফে আরোক্ষীর খুব জ্বর আসে, যদিও মায়ের মন্দিরে নিয়ে যাবার পর ও সুস্থ হয়। পুজোও দেওয়া হয় আরোক্ষীর মামাবাড়িতে। তবে পুজো দেবার জন্যই কিনা কে জানে ওরম ঘটনা আর কখনই ঘটেনি। তবে আরোক্ষী যে কটাদিন ছিলো মামাবাড়িতে, আর ছাদে যায়নি। যাও বা গেছে, দিনের বেলায়, সন্ধ্যের পর একা একদমই নয়।

ওটা কে ছিলো?

শ্রীলেখা কুন্ডু 

ছাদের ফুরফুরে শীতল হাওয়ার মনটা বেশ সতেজ হয়ে গেলো আরোক্ষীর, আজকের খাওয়াটা বেশ চেপে হয়েছে, মনে হচ্ছে আজ অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে হবে। খাওয়া-দাওয়ার পর হাঁটাহাটি করার অভ্যাস আরোক্ষীর আজকের নয়, সেই কিশোরী বয়স থেকে। বাবা শিখিয়েছিলেন, এতে নাকি খাবার তাড়াতাড়ি হজম হয়। সত্যি কি মিথ্যা জানে না, কিন্তু খাওয়া-দাওয়ার পর প্রত্যেকদিনই এটা করে থাকে আরোক্ষী, আজ মামাবাড়িতে এসেও ব্যাতিক্রম হয়নি। হ্যাঁ আজ সকালেই এসেছে মামাবাড়ি বাবা আর মায়ের সাথে, মা আর আরোক্ষী কটাদিন মামাবাড়িতে কাটাবে, বাবা আজ বিকেলেই চলে গেছেন হঠাৎ একটা কাজ পড়ে যাওয়ায়, না হলে রাতটা থেকে যাবার কথা ছিলো। আজ অনেক বছর পর মামার বাড়িতে থাকা হবে আরোক্ষীর, প্রায় পাঁচ বছর পর তো হবেই। অন্য সময় মাঝে-সাঝে মামাবাড়ি এলেও থাকা হয়নি, এখন উঁচু ক্লাসের পড়াশোনা, চাপও প্রচুর তাই বেশ কয়েক বছর ইচ্ছে উপায় ছিলো না। এখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর একটু শান্তি। যাইহোক, অনেক দিন পর ভালোভাবে ওদের পেয়ে মামাবাড়ির সবাই খুশি, আরোক্ষীও খুশি। আজ সবাই মিলে বেশ মজা হলো, মামি তো জম্পেস রান্না করেছিলেন, খাসির মাংস, দই ইলিশ, পোলাও, সব মিলিয়ে খাওয়াটা বেশ ভারী হয়ে গেছে।

শীতল হাওয়ায় মোবাইলে গান শুনতে শুনতে বেশ হাটছে আরোক্ষী, হঠাৎ চোখে পড়ল সিড়ির দরজার দিকে, সিঁড়ির দিকটা মিশমিশে অন্ধকার, ছাদেও অবশ্য অন্ধকার তবে তুলনামূলক কম, আজকাল গ্রামের রাস্তায়ও একটু আধটু আলো আছে, আগের মতো একদম মিশ মিশে অন্ধকারটা আর নেই। সেই টিমটিমে আলোয়, ছাদে একটু হলেও অন্ধকার ফিকে হয়েছে, আর সেই আলোতেই আরোক্ষীর মনে হলো, দরজাটা হালকা নড়ে উঠলো না? হ্যাঁ নড়েই তো উঠলো, এমনকি খুট করে হালকা আওয়াজও হলো একটা, দরজার পিছনে কি কেউ আছে? নাকি পুরোটাই মনের ভুল আরোক্ষীর? এতো জোরেও হাওয়া দিচ্ছে না যে দরজাটা ওইভাবে নড়ে উঠবে!! কেউ কি উঠে এসেছে? নাহ্, তাহলে তো সে ছাদে উঠে আসবে, মামাবাড়ির কেউ খামোখা ওখানে কেন দাঁড়াতে যাবে? আর এখন এতো রাতে বাইরের কেউ ও আসবে না। দুর হবে কিছু একটা, এই ভেবে ঠোঁট উল্টে তাচ্ছিল্য করে গান শোনায় মন দিলো আরোক্ষী। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আচমকা আবার সেদিকে চোখ পড়তেই বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। এবার যেন স্পষ্ট মনে হলো কেউ দরজার ওদিক থেকে আরোক্ষীকে লক্ষ্য করছে !! এখানে ওকে আড়াল থেকে লক্ষ্য করার মতো কে থাকবে? ব্যাপারটা কি হচ্ছে দেখবার জন্য আরোক্ষী মোবাইলের আলো জ্বেলে এগিয়ে গেলো, সিড়ির উপর থেকে নীচে অবধি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাউকেই দেখতে পেলো না আরোক্ষী, দুবারই মনের ভুল, হতে পারে কি? হতে পারে না কেন? হচ্ছেই তো; নিজেকে নিজেই বোঝায় আরোক্ষী। এবার ছাদের দিকে ফিরে সোজাসুজি তাকিয়েই থ হয়ে যায় আরোক্ষী, ছাদের ওইদিকের পাঁচিলের উপর ওটা কে বসে আছে? এবারেও কি চোখের ভুল? কিন্তু তা কি করে হবে অন্য গুলোতে না হয় দেখা যায়নি কিছু, এটা তো বেশ পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, কালো রঙের কোনো কিছুর ছায়া, আবার একটু দুলছে না? হ্যাঁ তাই তো… এটা কি কোনো বিড়াল? না তো, বিড়াল কি এতো বড়ো হবে? তাহলে? ভাবতে ভাবতে আগাগোড়া সাহসী আরোক্ষীরও কেমন যেন একটা অনুভূতি হতে লাগলো, মোবাইলের আলো জ্বালিয়েও যে দেখবে সে সাহসেও কুলোচ্ছে না, কিন্তু কিসের যেন অমোঘ আকর্ষণে সেখান থেকে ছুটেও পালিয়ে যেতে পারছে না, বরং সেই বস্তুটির দিকেই এগোতে লাগলো, যেতে যেতে পায়ে কিসের হোঁচট লাগতেই তাড়াতাড়ি আলো জ্বালিয়ে দেখে একটা টব !! আর কালো মতো বস্তুটা আর কিছুই না, ওই টবেরই গাছ !! এবার আর না থাকতে পেরে হায় হায় করে কপাল চাপরাতে লাগলো আরোক্ষী, সত্যি এতো বছর পর মামাবাড়িতে রাত কাটানোর চাপ যে এরম হবে ভাবতেই পারেনি আরোক্ষী, এই নিয়ে তিনবার বোকা বনে গেলো সে, নাতো তিনবার নয় চারবার, ছাদে ওঠার জন্য যখন অন্ধকারে সিড়ির দরজা খুলতে গেছে, তখনই অনুভব করে ঘাড়ে যেন কার নিঃশ্বাস, শুধু তাই নয়; নিঃশ্বাস ফেলবার শব্দটাও যেন শুনেছিলো, সেটা অবশ্য অস্পষ্ট ছিলো। তখনো সাথে সাথেই পিছনে ফেরে আরোক্ষী, কিন্তু ওই কাউকে দেখা তো দূর, কারো অস্তিত্বই টের পায়নি, শুধু চাপ চাপ অন্ধকার ছাড়া।

ধুত্তেরি, নিকুচি করেছে হাঁটাহাঁটির, বিরক্ত হয়ে যেই ছাদ থেকে নীচে যাবার উদ্দেশ্যে পিছনে ঘুরতে যাবে আরোক্ষী, ওমনি “হাউ” শব্দ, সেই সাথে আচমকা পিঠে জোর ধাক্কা !! “বাবা গো”, বলে চিৎকার করে ওঠে আরোক্ষী, ধাক্কার চোটে পড়েও যাচ্ছিল, নেহাত টাল সামলে নিলো তাই। তখনই পিছন দিক থেকে একটা খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসে। তখনই পিছনে তাকিয়ে দেখে, কান্ডখানা আর কারো নয়, ওর মামাতো বোন পিয়ুলীর। আরোক্ষী তো ওকে দেখে রেগেই আগুন।

পিয়ু তুই, দাঁড়া তোকে আমি…. বলে বোনকে মারতে যেতেই ও খিলখিল করে হাসতে হাসতে দৌড় দিলো, ওর পেছন পেছন আরোক্ষী, কিন্তু ও যে ওকে ধরতেই পারছে না, যখনই ধরতে যাচ্ছে পিয়ুলী যেন ছিটকে চলে যাচ্ছে, এ কি তার বোন পিয়ুলী? যে একবার দৌড়েই ধরা পড়ে যায় !! আর তাছাড়া আরেকটা জিনিস, ও যখনই পিয়ুলীকে ধরতে যাবে, পিয়ুও যেন কিভাবে সরে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে, ঠিক যেন হাওয়ায় ভেসে !! আরোক্ষী যা দেখছে সব ঠিক তো? এক সময়ে আরোক্ষী আর না পেরে থেমে গেলো, হাঁপিয়ে উঠেছে ও, দিদির দশা দেখে পিয়ুলী তো হেসেই খুন, তারপর যখন বুঝতে পারলো দিদি রাগ করেছে দিদির কাছে এসে সোজা নিজের কান দুটো ধরে বলে, “সরি দিভাই ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না প্লিজ, প্লিইইজ।” বোনকে এরম করতে দেখে আরোক্ষীও রাগ ভুলে হেসে উঠলো, “আচমকা এসে এরম করলি, ভয় লাগে না বলতো?” পিয়ুলী তখনো দুই কানে দুই হাত ধরে দাঁড়িয়ে, “বলছি তো ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না।” আরোক্ষীর খুব ভালো লাগলো এরম খলবল করে কথা বলতে থাকা বোনকে দেখে, এতোদিন শুধু ওর শান্ত স্বভাবটাই দেখেছে আরোক্ষী, এই জন্য কম রাগায়নি বোনকে, সকাল বেলা ওরা মামাবাড়িতে আসার পর বোনের সাথে এখনো পর্যন্ত ভালো করে কথা হয়নি আরোক্ষীর, এবার তাহলে বেশ গল্প করা যাবে…

“আচ্ছা আচ্ছা ঠিকাছে, আর কান ধরতে হবে না, আয় গল্প করি” বলে আরোক্ষী নিজেই বোনের কান থেকে হাত দুটো ধরে নামাতে গিয়েই আবার চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিলো?

“কি হলো রে দিভাই? চমকে উঠলি যে?” তারপর মুখে হাসি বুলিয়ে বললো, “আবার ভয় পেলি নাকি?”

“না মানে, তোর হাত দুটো এরম বরফের মতো ঠান্ডা কেন রে পিয়ু?”

“হাত দুটো !! ওওও, আসলে আমার খুব গরম লাগছিল তো তাই স্নান করে এসছি, কিন্তু চুল ভেজাইনি, হি হি হি।”

“স্নান, এই রাত্তিরে? তার উপর আবার তুই?”

“হ্যাঁ, কেন?”

“কেন মানে? একে তো ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব, তার উপর রাতের বেলা, অথচ তোর নাকি এতো গরম লাগছে তুই স্নান করে এলি, আর তাছাড়া তুই আগাগোড়া শীত কাতুরে বলে জানি, আর এখন বলছিস…!!!!”

“আর স্নান করলে কি কারো শরীর এরম বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যায়?” শেষের কথাগুলো আরোক্ষী নিজের মনেই বললো।

“কিরে দিভাই কি বিড়বিড় করছিস?”

“না কিছু না, তবে তুই কথায় কথায় এরম হাসিস না তো ভূতের মতো !!”

হাসি থামিয়ে পিয়ুলী বলে, “ভূতের মতো? আচ্ছা বাবা ঘাট হয়েছে, আর হাসবো না।”

তারপর আরোক্ষী আর পিয়ুলী গল্প করতে লাগলো। আরোক্ষী খেয়াল করলো, পিয়ুলীই যেন একটু বেশিই কথা বলছে, আরোক্ষী কথা কম বলবারই সুযোগ পাচ্ছে, যেটা সচরাচর হয় না। বরং অন্য সময় আরোক্ষী কথা বলতে থাকে, পিয়ু মন দিনে শোনে, হয়তো দু-চার কথার উত্তর দেয়।

খানিকক্ষণ পরে পিয়ুলী বলে ওঠে, “এই দিভাই, অনেক রাত হয়েছে রে, চল এবার নীচে যাই। আচ্ছা আগে আমি যাই, তারপর তুই আয়।” বলে আরোক্ষীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঝড়ের গতিতে অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো।

আরোক্ষী হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে বোনের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বোন চলে যাবার পর আরোক্ষীর মনে হলো চারিদিকে কেমন যেন একটা নিকষ কালো অন্ধকার আর নিরবতা গ্রাস করে আছে। আরোক্ষীর গাটা কি শিরশির করে উঠল? আর অপেক্ষা না করে ছাদ থেকে নেমে এলো সে।

ঘরে এসে দেখে, মা আর মামিমা তখনো বসে গল্প করছে বসার ঘরে। অনেকদিন পর তো দুজন গল্প করার এতো সময় পেয়েছে, তাই কথা আর ফুরুচ্ছে না।

আরোক্ষীকে দেখে মামিমা হাসলেন, মা জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় ছিলি মামন?”

“এইতো ছাদে ছিলাম।”

“ছাদে, এতো রাতে। তুই এতো রাতে ছাদে ছিলি? কেন? আমি ভাবলাম তুই বোধহয় দিদার ঘরে !!” মামিমা তো প্রায় আঁতকে উঠেছেন।

“হ্যাঁ, খাবার পর একটু হাঁটাহাঁটি করছিলাম !! কেন মামি?”

“না না মামন, রাতের বেলা আর ছাদে উঠবি না এরম, একা একা তো নই।”

“কেন গো বউদি, রাতের বেলা ছাদে উঠলে কিসের অসুবিধা, আর মামন তো এমনি সাহসী, তাই…”

মায়ের কথা শেষ না করতে মামি বলে উঠলেন, কিছুটা গম্ভীর ভাবেই, “দেখো ঠাকুরজি, তোমরা শহরের মানুষ তোমাদের কাছে এগুলো হয়তো হাসির বিষয় মনে হবে, কিন্তু আমদের মানে গ্রামের মানুষদের এসব মানতেই হয়, সন্ধ্যের দিকে একা বেরোনো, বা ছাদে ওঠা উচিৎ নয়, কতোকি আমাদের চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়, যেগুলো দেখা যায় না, কিন্তু…”

“কিন্তু কি বৌদি? আর তাছাড়া ছোটো থেকে আমিও তো বড়ো হয়েছি এখানে, সেরকম তো কিছু….” মায়ের মুখ থমথমে।

মামিমা হয়তো বুঝতে পারলেন এতোটা গম্ভীর হওয়া উচিৎ হয়নি। তাই নিজেকে তৎক্ষনাত সামলে নিয়ে হাসি মুখে বললেন, “আরে না তেমন কিছু না, আমিও না, কখন কি বলতে কি বলে ফেলি, বলি আজ রাতে কি ঘুমাতে হবে না? কটা বাজে সে খেয়াল আছে? কাল সকালে উঠতে হবে। চলো ঠাকুরঝি শুয়ে পড়া যাক।”

মামিমার কথায় মাও এবার হেসে ফেললেন, তবে হাসিটা যে জোর করে সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারলো আরোক্ষী। মা মামিমাকে বললেন, “হ্যাঁ বৌদি চলো শুয়ে পড়া যাক, অনেক রাত হলো, যা মামন তুইও শুয়ে পড়।”

-হ্যাঁ মামন যা বোনের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়, ও ঘরে একা আছে। তোর জন্যই আজকে ও নিজের ঘরে শুয়েছে, নাহলে যা ভীতু, এতো বড়ো হলো এখানো তোর দিদার সাথেই শোয়, আজ তোরা দুইবোনে একসাথে ঘুমা, অনেকদিন পর।

মা বললেন, “ও আরেকটু বড়ো হোক ঠিক হয়ে যাবে, ভেবো না বৌদি। এই তো…..

মা আর মামিমা কথা বলতে বলতে নিজেদের ঘরে চলে গেলেন, কিন্তু আরোক্ষীর মনে জোর খটকা, মামিমা কি বলে গেলেন? বোন ভীতু, একা শুতে ভয় পায় !!!

নাহ্ আর দাড়িয়ে থেকে লাভ নেই, অনেক রাত হলো, এবার শোয়া যাক। এই ভেবে আরোক্ষী বোনের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ঢুকে দেখে পিয়ুলী একটা বই পড়ছে, হাসির বই, এতো মনোযোগ দিয়ে পড়ছে যে দিদি আরোক্ষী ঘরে ঢুকেছে ও টেরই পায়নি। এদিকে আরোক্ষী ভাবছে, বোনটা কি বেরসিক(হাসির গল্পের বই পড়ে বেরসিক?) !! এই রাতেরবেলা কোথায় একটা টানটান ভয় মেশানো ভূতের বই পড়বে, তা না ও বাচ্ছাদের মতো হাসির বই…!! তবে ভূতের কথা মনে আসাতে আরোক্ষীর মাথায় ও একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেললো, সে আচমকা লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে সোজা বোনের পাশে। এদিকে পিয়ুলী তো ভীষণ চমকে গেছে, সে ভয়ে চেচিয়েই ফেলেছে, সেই সাথে একপাশে গুটিশুটি মেরে বসে দেখে দিদি, তবে ও যে খুব ভয় পেয়েছে সেটা ওর মুখ দেখলেই বোঝা যায়। এদিকে আরোক্ষী তো ওর অবস্থা দেখে হেসেই খুন, “কিরে কেমন দিলাম হ্যাঁ, তুই কি ভেবেছিস তুই একাই পারিস, আর কেউ পারে না?”

“দিভাই দেখ, এরকম ইয়ার্কি কিন্তু ভালো লাগে না, জানিস তো আমি ভয় পাই। এখনো আমার বুক ধরফর করছে” বলে পিয়ুলী নিজের বুকে হাত রাখে।

“ও, তাই নাকি, তুমি আবার ভয়ও পাও !! তা নিজের হলেই বুঝি শুধু ভয়টা আসে, আর ছাদে গিয়ে অন্যকে ভয় দেখাতে গিয়ে বুজি খুব সাহস বেড়ে যায়?”

মানে? কে ছাদে গেছে? ছাদে তো তুই গেছিলি, আর ভয়ই বা কে কাকে দেখিয়েছে?”

“বাবা রে, তোর তো দেখছি ভালোই উন্নতি হয়েছে বোনু !! সন্ধ্যাবেলায় দিব্বি ছাদে উঠে আমাকে আচমকা ভয় দেখিয়ে চলে এলি। আবার এখন ভয় পাবার অভিনয়, দারুণ দারুণ।”

“মানে? কি বলছিস দিদি? আমি কখন ছাদে গেলাম? এমনিতেই সিড়ি দিয়ে একা ছাদে উঠতে ভয় পাই, তার উপর আবার তুই বলছিস আমি ভয় দেখিয়েছি !!!”

“তুই কি বলছিস, ওটা তুই ছিলি না, শুধু ছাদে কেন, ছাদের দরজার ওইপার থেকেও তো….”

আরোক্ষীর কথা শেষ না করতে দিয়েই পিয়ুলী বলতে থাকে, “দিভাই, বিশ্বাস কর, তোকে ছুঁয়ে বলছি। আমি তো সন্ধ্যার পর একা ছাদে যেতেই ভয় পাই, আর মাও না বলে। তাও আজকে তুই ছিলি বলে মা যেতে বলছিল, যাতে তোকে ছাদে বেশিক্ষণ থাকতে না করি। কিন্তু বিশ্বাস কর, যাওয়া তো দূর, একা অন্ধকার সিড়িতে উঠতেই ভয় করছিল, তাই যাইনি। ওটা আমি ছিলাম না বিশ্বাস কর।”

“আর তুই কি আজ রাতে স্নান করেছিস?”

“স্নান? এতো রাতে !! তুই কি পাগল হলি দিভাই? বাইরে ঠান্ডা হাওয়া আর আমি করবো এখন স্নান, এই রাতে? আমি তো কাঠ-ফাটা গরমেও এতো রাতে স্নান করি না, বা করলেও খুব কম।”

আরোক্ষী আর কিছু বলতে পারলো না, বোনের কথা শুনে আর কান্না দেখে ওর মনে হলো বোন ঠিকই বলছে। অস্ফুট স্বরে আরোক্ষীর মুখ থেকে একটাই কথা বেরিয়ে এলো, “তাহলে ও কে ছিলো?”

ততক্ষণে আওয়াজ শুনে ও ঘর থেকে মা আর মামিমা এসে গেছেন, “কি হচ্ছে রে হ্যাঁ? এতো রাত হয়ে গেলো তোদের আর কথা শেষ হচ্ছে না !! একি পিয়ু তোর মুখটা ওরম কেন? কি হয়েছে? আর মামন তুই বা অমন মুখ করে বসে কেন? নিশ্চয়ই দুইবোনে ঝগড়া করছিলি?”

কাদো কাদো মুখে পিয়ুলী বললো, “দেখোনা পিসি দিদি কি সব বলছে?”

“কি বলছে?”

“আচ্ছা তোমরাই বলো, আজ কি দিভাই ছাদে ওঠার পর আমি ছাদে গেছিলাম?”

“না তো !!”

“তাহলে দিভাই যে বলছে…”

“কি বলছে? এই, খুলে বল তো তোরা, কি হয়েছে…”

তখন আরোক্ষী আর পিয়ুলী সব ঘটনা ওনাদের দুজনকে খুলে বলে।

আরোক্ষীর মা অবাক হয়ে নিজের বৌদির দিকে তাকাতে দেখেন, তাঁর মুখ সাদা কাগজের মতো ফ্যাকাশে !! কিছুক্ষন পর বলে ওঠেন, “দেখলে ঠাকুরঝি এই জন্যই তখন আমি বলছিলাম।”

“কিন্তু বৌদি….?”

ততক্ষণে আরোক্ষীর দিদা আর মামা এসে গেছেন, ওনারাও সব শুনলেন। যাইহোক, ওরা দুবোন ভয় পেয়ে গেছে দেখে মামা একথা সেকথা বলে কথার মোর অন্য দিকে নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ সবাই একসাথে কাটানোর পর যে যার গরে চলে গেল, কিন্তু দিদা ওদের কাছেই সেই রাতে শোবার জন্য রয়ে গেলেন, ছেলেমানুষ, ভয় পেয়েছে, আবার কখন কি হয়।

দুই ননদ বৌদি নিজেদের ঘরে এসে শোবার পর আরোক্ষীর মা কে পিয়ুলীর মা বললেন, “হ্যাঁ তখন কি যেন বলতে বলতে মা এসে পড়ায় থেমে গেলে ঠাকুরজি?”

“আমরাও তো এখানে বড়ো হয়েছি, কোনো দিন তো কিছু….”

“দেখো বউদি, কখন কি হয় বলা হয় না, তাছাড়া তোমাদের একটা কথা বলা হয়নি।”

“কি বলতো বৌদি, কোনো গুরুতর কিছু?”

“ধরে নাও তাই, আমাদের পাড়ার রুননু গো?”

“হ্যাঁ রুননু, ওর তো আমাদের পাড়ার দুটো পাড়া পরেই বিয়ে হয়, একটা মেয়েও আছে, কি যেন নাম ছিলো ওর?

“মেঘালী।”

“হ্যাঁ, মেঘালী। আমাদের পিয়ুর বয়সী বোধহয়, ওরই সাথে খুব ভাব ছিলো, কিন্তু মামনকেও খুব ভালোবাসতো।”

হ্যাঁ, আমাদের বাড়ির সবার সাথেই ওদের ভালো সম্পর্ক, ওর মার সাথে আসতে আসতে এই বাড়ির ন্যাওটা হয়ে গেছিল, আর কাছাকাছি মামাবাড়ি বলে মাঝেমাঝেই আসতো এখানে।”

“আসতো মানে? এখন কি আর আসে না? হ্যাঁ ওর কথা জিজ্ঞেস করবো করবো করে আর করা হয়নি, আমরা এলেই তো ও খবর পেয়ে চলে আসে, এবার দেখছি এখনো আসেনি।”

“আর আসবেও না।”

“আসবে না? কি বলছো বৌদি, কেন আসবে না কেন?”

মাথা ঠান্ডা রেখে শোনো ঠাকুরঝি, মন শক্ত করো। আসবে না কারণ ও আর নেই, তিনদিন আগে কি ভাবে যেন জলে ডুবে মারা যায়।”

“কি বলছো বৌদি?” আরোক্ষীর মা প্রায় চিৎকার কলে ওঠেন। “ওতো আমাকে মাসি মাসি করতো। সেবার মামনের একটা লিপস্টিক দেখে ওর খুব পছন্দ হয়, তাই মামন ওকে দিয়ে দেয়, আর তাতেই কি আনন্দ। আমরা যখন আসতাম, এখানে এলে ওতো আমার মামনের সাথেই বেশি ঘুরতো !!”

“শান্ত হও ঠাকুরঝি, আর একটু আস্তে বলো, মেয়েদুটো এমনিই ভয় পেয়েছে, তার উপর এসব শুনলে…”

আরোক্ষীর মা এবার একটু গলা নীচু করে বললেন, “কেমন কদে হলো গো বৌদি? আমরা এলে ও একদিন না একদিন ঠিক দেখা করে যেতো, কেমন সুন্দর কথা বলতো, একন সেই মেয়েকে আর দেখতে পাবো না !!””

“কেমন করে হলো সেটা আর কি ভাবে বলি ঠাকুরঝি, সাতার জানতো না, তাও পুকুরে গিয়ে স্নান করতো, কারো কথা শুনতো না। পাড়ে বসে মগে জল ভরে ঢালতো, ওতেই ওর আনন্দ ছিলো, অনেকে বলে পা কোনো ভাবে পিছলে গিয়েই নাকি….”

“তবে ঠাকুরঝি, আমি ভাবছি অন্য কথা।”

“কি গো বৌদি?”

“আমাদের কাছে এলেই ও তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করতো, মামনের কথা বিশেষ করে, ‘মামন দিদি কবে আসবে?’ একদিন শুনেছিলাম আমার মেয়েকে বলছে, ‘তোর খুব মজা, তোর অমন একটা দিদি আছে, তোকে কতো ভালোবাসে কতো কি দেয়, আমারো যদি থাকতো।’ এইতো, মারা যাবার কদিন আগেও খোঁজ করছিল ‘মামন দিদি কবে আসবে, আসলে বলো কিন্তু’ আর আজ মামনের সাথে এরম হলো।”

আরোক্ষীর মা এসব শুনে নড়েচড়ে বসলেন, “কি বলছো বৌদি, মামনের সাথে আজ যা হলো, তার সাথে কি মেঘালীর মারা যাবার জন্যই, মানে মেঘালী মৃত্যুব পর… না না, এরমও হয়?”

“দেখো ঠাকুরঝি, আগেও বলেছি, কখন যে কি থেকে কি হয় কেউ বলতে পারে না। আপাতত আজকের রাতটা ঠাকুরের নাম করো, কাল মাকে বলে মামন আর পিয়ু দুজনকেই মায়ের মন্দিরে নিয়ে যাবো, আর আমাদের বাড়িতেও কোনো পূজার ব্যবস্থা কথা যায় নাকি দেখবো। আপাতত যে কটাদিন তোমরা থাকবে মামনকে চোখে চোখে রাখতে হবে। আপাতত ঘুমাও।”

“হ্যাঁ সেই ভালো।”

এই ঘটনার পরেই মামন ওরফে আরোক্ষীর খুব জ্বর আসে, যদিও মায়ের মন্দিরে নিয়ে যাবার পর ও সুস্থ হয়। পুজোও দেওয়া হয় আরোক্ষীর মামাবাড়িতে। তবে পুজো দেবার জন্যই কিনা কে জানে ওরম ঘটনা আর কখনই ঘটেনি। তবে আরোক্ষী যে কটাদিন ছিলো মামাবাড়িতে, আর ছাদে যায়নি। যাও বা গেছে, দিনের বেলায়, সন্ধ্যের পর একা একদমই নয়।

আক্ষেপ_Sudipto Mukherjee

শিরোনাম – আক্ষেপ 

কলমে – সুদীপ্ত মুখার্জী 

বৌদিভাই আজ জমিয়ে ইলিশ মাছ টা রান্না করো দেখি। সর্ষে ইলিশ করবে কিন্তু ওপরে কাঁচা লঙ্কা দিয়ে । আমার তো ভেবেই মুখে জল চলে আসছে। ও হ্যাঁ আমার জন্য ভাজা মাছ কিন্তু দু-এক পিস এক্সট্রা রেখো।

একটু মুচকি হেসে শিল্পা বললো,

-ওরে বাবা রাখবো রাখবো। আমার ছোটো দেওর আবদার করেছে তাহলে তো রাখতেই হবে। আচ্ছা। বেশ সর্ষে ইলিশই হবে। তোমার পছন্দ মতো। এবার খুশি তো আদি বাবু?

-আরে হ্যাঁ ভীষণ খুশি। তোমার হাতের‌ সর্ষে ইলিশ সাথে বাঁশকাঠি  চালের ভাত। ওহ! আজ‌ দুপুরে খাবারটা জাস্ট জমে যাবে‌।

-হয়েছে হয়েছে। আর বৌদিভাইয়ের তারিফ করতে হবে না। তাড়াতাড়ি স্নানে যাও নাহলে মা আবার চিৎকার করবেন দুপুরের খাবার দিতে দেরি হলে।

-ভাজা মাছটা আমার জন্য রাখতে ভুলোনা কিন্ত মেজো বউদি।

আরে, হ্যাঁ ঠিক আছে রাখবো। তুমি এবার স্নানে যাও তো‌ ঠাকুরপো। আমার রান্না প্রায় শেষের দিকে।”

-জো হুকুম।

-এই আদি… স্নানে গেলি? পরে‌ বকবক করবি মেয়েটার সাথে। আমাকে হাতের কাজ ফেলে যদি উঠতে হয়েছে তাহলে এসে কিন্তু গরম খুন্তির ছেঁকা দেবো‌ মনে থাকে যেন।

ধুর! যাচ্ছি তো। এত চেঁচাও কেন মা ? চিৎকার করার কোনো কম্পিটিশন হলে তুমি নির্ঘাত ফার্স্ট প্রাইজ পেতে।

-মার খাবি আদি। তাড়াতাড়ি স্নানে করে আয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আদি স্নান সেরে এসে রীতিমতো হাঁকডাক শুরু করে দিলো।

-মা জলদি খেতে দাও। আমার পেটে ছুঁচো ডন মারছে তো। ও বৌদিভাই তুমি তো জানো আমি স্নান করে বসে থাকতে পারিনা আমার খুব খিদে পায়। এখন আর কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। রবিবারের ছুটি বাড়ি একটু বসে ওয়েব সিরিজ টাও দেখতে দেবে না। সাত তাড়াতাড়ি স্নান কর, স্নান করে মাথা খারাপ করে দেবে। ধুর! ভাল্লাগেনা।

-এত রাগলে হয় আদি বাবু? বিয়ের পর তো মিলির রাগ, দুঃখ,কষ্ট , অভিযোগের বোঝা তো তোমাকেই বইতে হবে নাকি?

-তুমি!

-আমি কি করে জানলাম তাই তো? তোমার মোবাইলে তোমার আর মিলির ছবিটা প্রথম দেখি। বাই দ্যা ওয়ে খুব কিউট কিন্তু। আমার মিষ্টি ঠাকুরপোর সাথে খুব মানিয়েছে।

মুচকি হেসে আদি বললো,

-থ্যাংক ইউ বৌদিভাই। তুমি তো জানো মা আমাকে আর দাদাকে নিয়ে কতটা পজেসিভ আর তোমাদের বিয়ে টা মা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি তাই তোমাকে অনেক কড়া কড়া কথা শুনতে হয়। আমার তো মিলিকে নিয়ে খুব চিন্তা হয় ওর যা মাথা গরম মাকে কি বলতে কি বলে বসবে তখন আরেক ঝামেলা। তখন আমি কার দিকে যাবো বলোতো?

হাসতে হাসতে শিল্পা বললো,

-ব্যাপারটা কিন্তু খুবই চিন্তার ঠাকুরপো।‌ এই বিষয়ে তোমার দাদার কাছে টিপস নিতে পারো। বিয়ের পর কিভাবে মা আর বউকে একসাথে ম্যানেজ করবে আর মা আমাদের বিয়েটা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। সেটা আমিও জানি। কি করবো বলো তোমার দাদাকে তো ছেড়ে চলে যেতে পারি না। বড্ড ভালোবাসি যে। মায়ের বয়স হয়েছে তাই ওনাকেও দোষ দেওয়া যায় না। ছেলে অপছন্দের মেয়েকে বিয়ে করলে মায়ের রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক কিন্তু আমার বিশ্বাস মা একদিন আমাকে মন থেকে ঠিক মেনে নেবেন। তবে মাঝেমধ্যে মায়ের বলা কিছু কথা শুনে খুব খারাপ লাগে। আমিতো ওনার মেয়েরই মত। যাইহোক অনেক বকবক হয়েছে এবার খেতে এসো দেখি।

-বৌদিভাই তুমি কাঁদছো?

-কই না তো। চোখে কি যেন একটা পড়লো। তুমি খেতে এসো ঠাকুরপো। খাবার বেড়ে বসে থাকতে নেই। তাড়াতাড়ি এসো।

-হুম। আসছি তুমি যাও।

-ঠাকুরপো তাড়াতাড়ি এসো। ভাত বেড়ে দিয়েছি।

-এই তো এসে গেছি। আরে বাপরে! এত কিছু ! ভাত, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, ইলিশ মাছ ভাজা, চিকেন কষা  আবার আমার ফেভারিট সর্ষে ইলিশ আর আমের চাটনি। লাঞ্চ তো পুরো জমে ক্ষীর‌ বৌদিভাই।

-চিকেন কষাটা ইউটিউব দেখে ফার্স্ট টাইম ট্রাই করলাম। কেমন হয়েছে বলোতো?

-টেস্ট করে বলছি।

-হুম। বলো কেমন হয়েছে?

-উফ! এক কথায় অনবদ্য। তোমার হাতে জাদু আছে কিন্তু বৌদিভাই।

-খেতে এত ভালো হয়েছে ঠাকুরপো?

-তা তো হবেই বৌদিভাই। কে রান্না করেছে দেখতে হবে তো। একেবারে সাক্ষাত দেবী অন্নপূর্ণা।

-বাবাগো বাবা। ঢং দেখলে বাঁচিনা। আদি একেবারে দেবী আসনে বসিয়ে দিলি মেয়েটাকে? কটা দিন হলো তো এই বাড়িতে এসেছে।

-উফ! মা চুপ করো তো। বৌদিভাই রান্না ভালো করেছে তাই প্রশংসা করেছি। তাতে কি সমস্যা?

-এতদিন তো আমার হাতের রান্না চেটেপুটে খেতিস। আজ এই মেয়েটা আমার ছেলেটাকে বিয়ে করে দুদিন বাড়িতে আসতে না আসতেই সবার ওপর কি যাদু করলো কে জানে? হ্যাঁ গো মেয়ে তা তুমি কি বশীকরণ জানো নাকি?‌ আমার বড় ছেলেটার মাথা খেয়ে তো বিয়ে করে বাড়িতে পা দিলে এবার ছোট ছেলেটার মাথা খাওয়া শুরু করেছো। যে ছেলে আমার অনুমতি ছাড়া কোনোদিন কোনো কাজ করেনি। সেই ছেলে একেবারে তোমার সিঁথিতে সিঁদুর তুলে একেবারে বাড়িতে এনে হাজির করলো। ভালো ভালো রান্না আর মিষ্টি কথাতে ভুলিয়ে আমার ছেলেদের মাথা খেয়ে তাদেরকে তোমার দলে টানতে পারো তুমি যদি ভেবে থাকো এভাবে আমাকেও বশ করবে তাহলে সম্পূর্ণ ভুল ভাবছো।

-তুমি আর একটা বাজে কথা বৌদিভাইকে নিয়ে বললে আমি কিন্তু খাবার ছেড়ে আবার উঠে যাবো। তোমার সমস্যা টা ঠিক কোন জায়গায় বলবে আমাকে মা?

-দুদিন আগে বাড়িতে আসা মেয়েটার জন্য তুই তোর মায়ের সাথে ঝগড়া করছিস? তোর দাদা তো বিয়ের পর একটা মেরুদণ্ডহীন পুরুষে পরিণত হয়েছে । বউয়ের কথাই ওঠে আর বসে। তুইও ট্রেনারের কাছে ট্রেনিং টা ভালোই পাচ্ছিস। তুইও কাউকে একটা ধরে নিয়ে আয় তাহলে ষোলো করা পূর্ন হয়। তারপর দু বউ মিলে বাড়িতে রাজত্ব করুক আর তোরা দু ভাই বৌদের পদসেবা করবি। এই দিনটা দেখার জন্যই তো ভগবান আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি এই দিন দেখার আগে যেন তাড়াতাড়ি ওপরে যেতে পারি।

-ধুর! তোমার রোজকার এই এক অশান্তি আমার আর ভালো লাগে না। নিকুচি করেছে খাবার।

-ঠাকুরপো না খেয়ে উঠতে নেই। বসো।

-না বৌদিভাই মায়ের এই একই অশান্তি আমার আর ভালো লাগছে না। ছুটির দিনে বাড়িতে আছি একটু শান্তিতে খাবার খাওয়ার জো নেই। অনেক খাওয়া হয়েছে। আমার পেটে ভর্তি। আমি উঠলাম।

-মায়ের সাথে কেউ এইভাবে কথা বলে? আমি যেন আর না দেখি তুমি এভাবে মায়ের সাথে কথা বলছো। তোমাকে বসতে বললাম ঠাকুরপো। খাবার ছেড়ে উঠতে নেই। খেয়ে নাও নাহলে আমি খুব রাগ করবো।

-আর নাটক করতে হবে না। মা ছেলের মধ্যে অশান্তি লাগিয়ে সাধু সাজা হচ্ছে? তোমার মত মেয়েদের আমি ভালো করে জানি।

আদি কে ইশারায় চুপ করে খেতে বলে শিল্পা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছতে লাগলো। হঠাৎ হাতে রাখা ফোনটা বেজে উঠতেই শিল্পা দেখলো‌ ওর ননদ অদ্রিজা কল করছে। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অদ্রিজার গলা ভেসে এলো।

-হ্যালো, বৌদি কেমন আছো?

-আমি ভালো আছি রে। তুই কেমন আছিস? সুজয়ের কি‌ খবর?

-সেও দিব্যি আছে। বলছি বৌদি মায়ের ফোনটাতে কল করলে নেটওয়ার্ক কভারেজ এরিয়ার বাইরে বলছে। তুমি একবার মাকে ফোনটা দাও না।

-সে না হয় দিচ্ছি। সম্পর্ক টা কি শুধু মায়ের সঙ্গে? আরো যে একটা দাদা, ভাই আর নতুন বৌদি আছে তাদের কথা মনে পড়েনা বুঝি? একবার তো দেখতে আসতেও মন যায়না?

-তা তো করে বৌদি। তাই তো‌ চলে এলাম তোমাদের দেখতে।

-মানে?

-আরে দরজাটা খোলো। তবে‌ তো আমাকে দেখতে পাবে।

দরজাটা খুলতেই অদ্রিজা জড়িয়ে ধরে শিল্পা কে বললো,

-সারপ্রাইজ টা কেমন লাগলো বৌদি? খুব মিস করছিলাম তোমাদের তাই তো চলে এলাম দেখা করতে।

-খুব খুব ভালো লাগলো। মাঝে মধ্যে এরকম সারপ্রাইজ দিতে পারিস তো। তা পতিদেব কোথায়?

এই যে বৌদি আমি এখানে।

-কতক্ষণ আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে? ভেতরে এসো।

-মা দেখুন কারা এসেছে।

-কি হলো ? ষাড়ের মতো চিৎকার করছো কেন?

-ও মা! আমার মেয়ে জামাই এসেছে। এসো ভেতরে এসো। এই মেয়েটা নিশ্চয়ই এতক্ষণ তোমাদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো? কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। শুধু বড় বড় বাতেলা।

-মা তুমি কিছু না জেনে শুধু শুধু বৌদিকে কেন দোষারোপ করছো? আমরা জাস্ট দু মিনিট হলো এসেছি। এত ওভাররিয়্যাক্ট করার কিছু হয়নি।

-আসতে না আসতেই বৌদির গুনগান করা শুরু হয়ে গেল?

-উফ! তোমার সাথে কথা বলা বেকার। বৌদি ভাই কোথায় গো? দাদা আজকেও বাড়িতে নেই?

না রে। তোর দাদা তো কনফারেন্সের জন্য দিল্লি গেছে আর আদি ওর রুমে শুয়ে আছে।

-এই বৌদি তোমাদের লাঞ্চ হয়ে গেছে?কেমন অসময়ে এসে পড়লাম বলো? ওকে কতবার করে বারণ করলাম এখন না গিয়ে বিকেলে চলো। একেবারে বৌদি, দাদা, আদি সবাইকে নিয়ে মুভি দেখে ডিনার করে বাড়ি ফিরবো। তা উনি বললেন দুপুর থেকে যাবো সবার সাথে একটু করব হৈ হুল্লোড় করবো। মজা হবে তারপর বিকেলে মুভি দেখে ডিনার করে বাড়ি ফিরবো।

-নিজের বাড়ি আসবি তো এটাতে আবার সময়ে অসময়ে আসার কি আছে রে ? বিয়ে করে খুব বড়ো হয়ে গেছিস? আদির খাওয়া হয়েছে শুধু। আমার আর মায়ের বাকি। তুই আর সুজয় এসেছিস তোরাও এখানে লাঞ্চ করবি আমাদের সাথে।

বৌদি আমরা লাঞ্চ করে এসেছি।

-করে এসেছিস তো কি হয়েছে? আরেকবার করবি।

-বৌদি আমি একবার ভাইয়ের সাথে কথা বলে আসি।ব্যাটার কোনো খবর নেই। দিদিকে একদম ভুলে গেছে।

-ভাই এই ভাই… দরজাটা খোল। এই দুপুরে দরজা দিয়ে কোন‌‌ মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিস?

-দিভাই তুই কখন এলি? আসলে হেডফোন লাগানো ছিলো ওই জন্য শুনতে পাইনি। তুই একা এসেছিস? জিজু আসেনি?

-হ্যাঁ। ও এসেছে। একটু পরে রেডি হয়ে নিস। বিকেলে মুভি যাবো তারপর রাত্রে ডিনার করে বাড়ি ফিরবো।

-আচ্ছা। ঠিক আছে।

-অদ্রি, সুজয় খেতে আয়। মা খেতে আসুন। খাবার বেড়ে দিয়েছি।

-এ কি বৌদি এতকিছু কি করেছো? বাপরে! আমি বা অদ্রি কেউই এত খাবো না। তুমি বললে তাই তোমার কথা কাটতে পারবো না তাই অল্প করে ভাত মুখে দিচ্ছি। তুমি ইলিশ টা উঠিয়ে নাও আর ডালটাও আমি বরং চিকেন দিয়ে খাচ্ছি।

-যেটা দিয়েছি চুপচাপ খাও। কিচ্ছু ওঠাবো না। অদ্রি তাড়াতাড়ি আয়। ভাতগুলো ঠান্ডা হচ্ছে তো। মা আসুন। অনেক বেলা হয়ে গেলো।

-এই তো বৌদি আসছি। তুমিও একেবারে আমাদের সাথে বসে যাও। আর কত দেরি করবে?

-এই যে মেয়ে একবার তো বললে। শুনতে পেয়েছি। এত চিৎকার করার কি আছে?

-বৌদির সাথে একটু ভালোভাবে কথা বলতে পারো না মা? তুমি আসতে দেরি করছো বলে তো তোমাকে বৌদি খেতে ডাকলো। চিৎকার কখন করলো?

-আমার সব কথাই তো এখন খারাপ লাগবে।

-আমার ভুল হয়েছে মা। আমি চিৎকার করে ডাকবো না। আপনি খেতে বসুন।

-বৌদি তুমিও বসে যাও আর দেরি করো না। কথায় কথায় অনেকটা বেলা হয়ে গেলো। আবার একটু পরে রেডি হয়ে বেরোবো।

-এ কি সুজয় এত কম ভাত! পাতে ডাল নেই, ইলিশ মাছ,  চাটনি কিচ্ছু দেয়নি এই মেয়েটা। চার পিস মাংস দিয়ে কি ভাত খাওয়া যায় নাকি? আমি তোমাকে মাছটা দি। শুকনো ভাত খেতে নেই ডাল দিয়ে ভাতটা মাখাও।

-হ্যাঁ গো মেয়ে তোমার ওই রাক্ষুসে পেটটাতে আর এত খাবার ঢুকবে? জামাইকে তো কিচ্ছু দাওনি। সব কি নিজের পেটে ঢোকানোর জন্য রেখে দিয়েছো নাকি?

-বৌদিকে নিয়ে আপনার সমস্যাটা ঠিক কোন জায়গাতে বলুন তো মা? আমি আর আপনার মেয়ে দুজনেই লাঞ্চ করে এসেছি তাই বৌদি কে বললাম যে আমাদের অল্প করে খাবার দিতে। আমাদের দুজনকে থালা সাজিয়ে ইলিশ মাছ, মাংস, চাটনি, ডাল সব দিয়েছে। আমরা খেতে পারবো না বলে উঠিয়ে দিয়েছি, আপনি কিছু না জেনে বৌদিকে কেন দোষারোপ করছেন?

-মালতি এদিকে একবার শোন। বাড়ি যাওয়ার সময় তোর ছেলের জন্য  মাংস আর দু পিস ইলিশ মাছ তুলে রেখেছি ওটা নিয়ে যাস।

-বড়ো ম্যাডাম দুদিন ধরে ছেলের জ্বর। কিচ্ছু খাচ্ছে না। বেকার ওর জন্য নিয়ে যাবো ও খাবে না‌ আর আমার স্বামীটা চলে যাওয়ার পর থেকে আমি আর মাছ , মাংস খায় না।

-খুব মহান কাজ করেছো। তুইও যখন খাস না তোর ছেলেও যখন খেতে পারবে না তো আর‌ কি করা যায়  বাড়ি যাওয়ার সময় পাড়ার মোড়ে  কুকুরগুলোকে দিয়ে দিবি।

-কিন্তু বড়ো ম্যাডাম বৌদি যে এখনো খাইনি। আমি তার ভাগের খাবারটা কি করে কুকুরকে দিয়ে দি বলুন? আমি পারবো না। পারলে আমাকে ক্ষমা করবেন।

-যা যা ভাগ এখান থেকে। বেশি নাটক করিস না।

-ছি ছি! তোমাকে আমার মা বলে ডাকতে ঘেন্না হচ্ছে।

-তোরা আমাকে ভুল বুঝছিস। আমি সেরকম কিছু বলতে চাইনি।

-আমি বা তোমার জামাই কেউই তোমাকে ভুল বুঝছি না। একদম ঠিক বুঝেছি। তোমার প্ল্যান ছিল দাদার বিয়েতে মোটা টাকা পণ নিয়ে বিয়ে দেওয়ার। তোমার তো সেই শখটা পূরণ হয়নি আর দাদা আর ভাই তোমার এই অন্যায় জিনিসগুলো মেনে নেয় না বলে কাছে তারা ‘মেরুদণ্ডহীন পুরুষ’ আর তাই তুমি নিজের ইগো স্যাটিসফাইড করার জন্য বৌদিকে অকারণ হিউমিলেট করো আর তোমার এটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে‌। তুমি মানসিকভাবে অসুস্থ।

-একটু ভুল বললে অদ্রি। তোমার মায়ের কাছে ওনার নিজের ছেলেরা ‘মেরুদণ্ডহীন পুরুষ’ কারণ দাদা আর আদি মায়ের অন্যায়গুলোকে সাপোর্ট করে না তাই তারা খারাপ। সে ক্ষেত্রে আমিও তো একই ক্যাটাগরিতে পড়ছি তাই না মা? কিন্তু তোমার মায়ের উত্তর হবে না। কারণ বেশিরভাগ বিয়ে হওয়া মেয়ের মা-বাবা চান তার মেয়ের হাসবেন্ড তার মেয়ের কথা শুনে চলুক, তার মেয়ে সুখে থাকুক কিন্তু সেই মায়েরই নিজের ছেলে যদি তার বউয়ের কথা শোনে, তার মতে একটা কাজ করলে , মায়ের অন্যায় না মেনে স্ত্রীকে সাপোর্ট করলে তখন সেই ছেলে হয়ে যায় ‘মেরুদণ্ডহীন’, ‘জোরু কা গোলাম’,’ বউপাগলা’ আরও কত কি। তফাৎটা এখানেই। সেই ছেলের বৌ টিকে শুনতে হয় নানা কটূক্তি। সেগুলো আর নাই বা বললাম মা। একটু আগে অনেক কথাই বলছিলেন সেগুলোর রিপিট টেলিকাস্ট করতে ইচ্ছে করছে না। আশাকরি আমি আমার কথাগুলো বোঝাতে পেরেছি?

অদ্রিজা বললো,

-টাকা দিয়ে জীবনে সব কিছু বিচার করা যায় না মা। বৌদি বিয়ে করে যখন এই বাড়িতে আসে বৌদির বাবা তোমাকে বলেছিলো – বেয়ান আমার মেয়েটার জন্মের পরেই ওর মা মারা যায়। ছোট থেকে মায়ের আদর পায়নি মায়ের ভালোবাসা কি জিনিস ও জানেনা। আমি জানি আপনি ওকে নিজের মেয়ের মতন ভালোবাসবেন। নাকি নিজের মায়ের মতনই ভালোবাসবে শ্রদ্ধা করবে, আপনাকে কোনোদিন কষ্ট পেতে দেবেনা। মেয়েটা কোনদিন কোনো অন্যায় করে থাকলে আপনার এই মেয়ের মতন ওকেও ক্ষমা করে দেবেন। আজ মানুষটা নেই। অষ্টমঙ্গলার পর বৌদিকে একটা বারের জন্য দেখতে আসার সুযোগ পেলেন না। ওপার দুনিয়ায় তোমার দেওয়া মিথ্যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে উনি ভালো আছেন।

-কি হলো খাবার ছেড়ে উঠে যাচ্ছিস কেন?

-আমি তোমার মত এতটা নির্লজ্জ হতে পারলাম না মা। বাড়ির বউকে অভুক্ত রেখে পাড়ার কুকুরকে খাইয়ে পুণ্য কামানোর আশা করলে ভগবান তোমাকে পাপের ভাগীদারই করবে।

-চলো সুজয়। আমরা এরপর সেদিনই এই বাড়িতে পা দেবো যেদিন মা বৌদিকে মন থেকে মেনে নিতে পারবে।

-জানিস অদ্রি, ভগবান আমাকে সব দিয়েছে তোর  দাদার মতন একজন স্বামী, আদি আর সুজয়ের মতন দুটো ভাই, তোর মতন একটা মিষ্টি বোনের এত ভালবাসা দিয়েও একটা জিনিস ঠিক কেড়ে নিয়েছে সেটা হল মায়ের ভালোবাসা। ওই কথায় আছে না কুচ পানে কে লিয়ে কুছ খোনা পড়তা হে। সেই হয়েছে আমার অবস্থা। এতকিছু পাওয়ার পরেও বিয়ের আগে আর পরে মায়ের আদর, ভালোবাসা আর স্নেহের পরশ না পাওয়ার আক্ষেপটা আমার রয়েই গেলো।